ধর্মঠাকুরের পুজো প্রায় ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। সত্যিকারের ধর্মঠাকুর নয়। বরং অনেকখানিই মিথ্যের। হ্যাঁ, ধর্মের নামে যে হানাহানি চলছে তা বলতেই খানিকটা হেঁয়ালির আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এ-কথা সত্যি যে, আমাদের বাংলার সত্যি সত্যিই একজন নিজস্ব ধর্মঠাকুর আছে। সবথেকে মজার কথা এই যে, এই ধর্মঠাকুর বিভাজন তো দূরের কথা, বরং স্বয়ং এক সমাবেশ। এখন অবিশ্যি উলটপুরাণ।
বৈদিক এবং পৌরাণিক আর্য, অনার্যর উভয় পদ্ধতির সমাবেশ হয়েছিল
আমাদের এই একান্ত নিজের ধর্মঠাকুর কোনো একক দেবতা ছিলেন না। বরং নানা মতের নানা দেবতার সম্মিলন। মূলত যোদ্ধা ডোম জাতির আরাধ্য ছিলেন তিনি। তারপর তাঁর শরীরে মিশল, বৈদিক বরুণ দেবতা, রথারোহী সূর্য, অবৈদিক কূর্মাবতার ও আরো অনেকে। আর্য-অনার্যদের আরাধ্য নানা দেবতার মিশেলে তৈরি হয়েছিল বাংলার এই নিজস্ব দেবতা। সুকুমার সেন জানাচ্ছেন, এই ধর্মঠাকুরের পুজো পদ্ধতিতে স্পষ্টতই বৈদিক এবং পৌরাণিক আর্য, অনার্যর উভয় পদ্ধতির সমাবেশ হয়েছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো পণ্ডিতজন অবশ্য এই ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ ধর্মের পরিণতি হিসেবে দেখেছেন। যদিও সুকুমারবাবু জানাচ্ছেন, এই ধর্মঠাকুরের পুজোয় যে শূন্যমূর্তি তা বৌদ্ধ নির্বাণের শূন্য ধারণা নয়। বরং তার অর্থ নিষ্কলঙ্ক বা শুভ্র। এর সপক্ষে তিনি বেশ কিছু প্রমাণ ও প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন। বিস্তারিত না গিয়ে আপাতত এই নিষ্কলঙ্ক ও শুভ্র শব্দটিকে আমরা একটু নাড়াচাড়া করে দেখি। এমন এক দেবতা যিনি কিনা অনেকগুলো মতের সম্মিলনে তৈরি তাঁকেই শুভ্র তথা কলঙ্কহীন কল্পনা করে ধ্যান করা হচ্ছে। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই সম্মিলনের দেবতা আসলে কোন বার্তা বহন করে চলেছিলেন।
বস্তুত ধর্ম তো সেই শুভ্রতারই দ্যোতক। শুভ্রতা – যা কিনা সমস্ত রঙের মিলন। শুভ্রতার মতোই ধর্ম শাশ্বত। অধ্যাপক যতীন সরকার চমৎকারভাবে আমাদের বুঝিয়ে দেন, “ভারতের ঋকবেদ সংহিতায় একটি শব্দ পাওয়া যায় – ‘ঋত’। পাশ্চাত্যের বেদবিদ পণ্ডিতগণ এই ঋতের অর্থ নির্দেশ করেছেন ‘বিশ্বের প্রাকৃতিক ও নৈতিক নিয়মানুবর্তিতা।’ মহাভারতের ধর্ম আর ঋকবেদ সংহিতার ঋত অভিন্ন অর্থের ধারক। ইসলামে যাকে বলা হয়েছে ‘ফিতরৎ’ তাও ওই শাশ্বত ধর্মের সঙ্গে একার্থক।” আমরা যে অবতারে বিশ্বাস করি, তাঁদের আবির্ভাবও ধর্ম প্রতিষ্ঠাতেই। যে ধর্ম এক একটা রিলিজিয়নকে আশ্রয় করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আবার সময় বদলায়। মানুষের মন, জীবনের ধারা বদলায়। ফলে পুরনো রিলিজিয়ন ছেড়ে আবার নতুন রিলিজিয়নের আশ্রয় নেয় সভ্যতা। কিন্তু উদ্দেশ্য বদলায় না। সেখানেও নিহিত থাকে সেই ধর্মপ্রতিষ্ঠা।
আমাদের এই একান্ত নিজের ধর্মঠাকুর কোনো একক দেবতা ছিলেন না। বরং নানা মতের নানা দেবতার সম্মিলন।
সন্দেহ নেই আলোচনার বিষয়টি বহুকৌণিক। নানা বিশ্লেষণ, তত্ত্ব-যুক্তি ইত্যাদির অবতারণা এ প্রসঙ্গে চলতে থাকাই স্বাভাবিক। চুম্বকে এই উঠে আসে যে, ধর্ম কখনও ভিন্নতা আশ্রিত হয় না। ধর্ম সতত একই। রিলিজিয়নের বরং বিভিন্নতা থাকতে পারে। সেই বিভিন্নতা মাথায় রেখেই আমরা সেক্যুলার শব্দটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে ব্যবহার করি। সেটা প্রচলিত অর্থে ব্যবহৃত হলেও মূলত বিভ্রান্তিমূলক। বরং সেক্যুলার অর্থে আমরা বুঝব ইহলৌকিক। অর্থাৎ, ধর্মে স্থির থাকা বা ধর্মে মতি রাখতে হলে পরজন্ম বা পূর্বজন্মের দিকে তাকানোর দরকার নেই। মানবিকতার পথ, ধর্মের পথ এক জীবনেরই। সেখানে সেই শাশ্বত নিয়ম বা নৈতিকতা, যা মানুষকে উত্তরণের পথে নিয়ে যায়, তা থেকে সরে আসার কোনো প্রশ্নই নেই।
আমার ভাবতে ভালো লাগে, সমস্ত রকম বিভাজনকে পেরিয়ে, নানা মতের সম্মিলন ঘটিয়ে, এই বাংলাতেই একজন ধর্মঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এককালে। ধর্মের পাদুকা গলায় ঝুলিয়ে চলতেন ধর্মের পূজকরা। এই পাদুকাই ছিল ধর্মঠাকুরের প্রতীক। কেন? অনুমান করি, পাদুকা এক নতুন যাত্রার সূচনা ইঙ্গিত করে। সে যাত্রা সম্মিলনের। এ ইতিহাস তো একেবারে বিস্মৃত নয়। অথচ আজ বাংলায় যে ধর্মঠাকুরের পুজো চলছে, গোটা দেশেও, তা যে যথেষ্ট উদ্বেগের সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ঠাকুরের কোনো মূর্তি নেই। কিন্তু এই কল্পিত ধর্মঠাকুর সমস্ত অধিভাষাকে আশ্রয় করে অপদেবতার মতোই সেই প্রাচীন ধর্মঠাকুরের পাদুকাখানা যেন কেড়ে নিয়েছে। সেই সম্মিলনের যাত্রা ছেড়ে আবার বিভাজনের পথ ধরিয়েছে তার আরাধ্যদের। আফিম এবার নতুন রকম। ঐতিহাসিকভাবেই রিলিজিয়নের উদ্ভব বরাবর শোষিতেরই রক্ষাকবচ হিসেবেই। পরে শাসক যখন নিজের রক্ষার্থে তাকে ঢাল করে, তখনই এই আফিম মারাত্মক হয়ে ওঠে। এখন সেই মারাত্মক নেশার জোরেই নেত্য চলছে। সেকালে, ধর্ম ঠাকুরের পুজোয় নাচের প্রচলন অবশ্য ছিল। শিবের গাজনের মতোই, ধর্ম-গাজনে নাচের নাম ছিল, পাতা-নাচ। মদ্যের নৈবেদ্য দেওয়ারও চল ছিল। মিথ্যে ধর্মঠাকুরের পুজোতে নেশার চল হয়েছে। তবে সে নেশা যে মারণরোগের কোপ দিচ্ছে, তার থেকে আমাদের সম্ভবত নিষ্কৃতী মেলা দুষ্কর। যদি না আমাদের আদি ধর্মঠাকুরের সেই পাদুকাখানা আমরা পুনরুদ্ধার না করি। এখনই, এই মুহূর্তেই।