‘তু সবকা খুদা, হে কৃষ্ণ কানহাইয়া, নন্দ লালা, আল্লাহ্ গণি, আল্লাহ্ গণি’

ভক্তিযুগ এবং সুফিবাদের মধ্যে অসাধারণ সমন্বয়। সুফিবাদ ঈশ্বর ও ভক্তের সম্পর্ককে প্রেমিক ও প্রেয়সীর সম্পর্ক বলে মনে করে। তাই রাধা বা গোপী বা সখাদের কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসা সুফিবাদের সংজ্ঞার সঙ্গে কোথাও গিয়ে মিলে যায়। এবং এখানেই চলে আসে সম্প্রীতির প্রসঙ্গও। নজর জাকির তাঁর ‘ব্রিফ হিস্টোরি অব বেঙ্গলি লিটেরেচার’ প্রবন্ধে লিখেছেন, চৈতন্য মহাপ্রভুর অনেক মুসলিম অনুসারীও ছিলেন।

একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, গান্ধিবাদী এবং ওড়িশার প্রাক্তন গভর্নর (১৯৮৩-৮৮) বিশ্বম্ভর নাথ পান্ডে বেদান্ত এবং সুফিবাদের তুলনামূলক একটি নিবন্ধে কিছু মুসলিম কৃষ্ণভক্তের কথা উল্লেখ করেছেন। এঁদের মধ্যে প্রথম সৈয়দ সুলতান, যিনি তাঁর ‘নবী বংশ’ গ্রন্থে কৃষ্ণকে নবীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। এরপর আসবে আলি রাজার নাম। তিনিও কৃষ্ণ ও রাধার প্রেম নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তাছাড়াও সুফি কবি আকবর শাহও কৃষ্ণ বিষয়ে অনেককিছুই রচনা করেছেন। বিশ্বম্ভর নাথ পান্ডে বলেছেন, বাংলার পাঠান শাসক সুলতান নাজির শাহ এবং সুলতান হোসেন শাহ মহাভারত ও ভাগবত পুরাণ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সেই সময়কার প্রথম অনুবাদ হিসাবেও স্বীকৃত এটি।

সেই যুগের সবচেয়ে চর্চিত কবি আমির খসরুর কৃষ্ণের ভক্তির কথা তো সচেতন পাঠক মাত্রই জানেন। কথিত আছে, একবার নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (Nizamuddin Auliya) স্বপ্নে নাকি শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন। নিজামুদ্দিন তাঁর বিখ্যাত কাওয়ালি ‘রঙ’-এ কৃষ্ণের জন্মস্থান (গোকুল) উল্লেখ করেছেন। আউলিয়া কৃষ্ণের প্রশংসায় আমির খসরুকে কিছু লিখতে বললে খসরু লেখেন, ‘ছাপ তিলক সব ছিনি রে সে মোসে নৈনা মিলায়েকে’।

তাছাড়াও আসবে সাইদ ইব্রাহিম (Syed Ibrahim) ওরফে ‘রসখান’-এর নাম। সুরদাসের মতো তিনিও কৃষ্ণলীলা বর্ণনা করেছেন। সাধারণ ব্রজ ভাষা রসখানের কৃষ্ণ কল্পনায় ব্যাপ্ত হয়। ভাগবত পুরাণকে ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন তিনি। গোস্বামী বিঠনাথের কাছ থেকে ভক্তিমার্গ শিখেছিলেন এবং বৃন্দাবনে বসবাস শুরু করেছিলেন। এখানেই রসখানের তাঁর সমগ্র জীবন অতিবাহিত। ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয় রসখানের। তাঁর সমাধি রয়েছে মহাবনে, যা মথুরার প্রায় ছয় মাইল পূর্বে।

আরও পড়ুন
‘মাসান’— রাধা-কৃষ্ণের বদলে শিব-পার্বতীকে কেন্দ্র করেই হোলির উদযাপন বেনারসে

আলম শেখ ছিলেন আচার আমলের কবি। তিনি ‘আলম কেলি’, শ্যাম স্নেহী’ এবং মাধবনাল-কামকান্দালা’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। রামচন্দ্র শুক্লা ‘হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাস’-এ লিখেছেন, আলম ছিলেন একজন হিন্দু যিনি ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রেমের প্রাবল্যের দিক থেকে আলমকে ‘রসখান’-এর সঙ্গে তুলনা করা উচিত বলে মনে করেছেন তিনি। প্রসঙ্গত, নাজির আকবরাবাদীও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম। নাজিরের দৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণ দুঃখ দূরকারী, করুণাদাতা এবং পরম আরাধ্য। তিনি কৃষ্ণচরিতের সঙ্গে রাসলীলারও বর্ণনা করেছেন। কৃষ্ণের বড় ভাই বলদেবকে নিয়ে ‘বলদেব জি কে মেলা’ নামে একটি কাব্যও লিখেছেন। কৃষ্ণের স্তুতি লিখে তিনি তাঁকে সকলের ঈশ্বর বলেও বর্ণনা করেছেন— ‘তু সবকা খুদা, সব তুঝপে ফিদা, আল্লাহ্ গণি, আল্লাহ্ গণি/ হে কৃষ্ণ কানহাইয়া, নন্দ লালা, আল্লাহ্ গণি, আল্লাহ্ গণি/ তালিব হে তেরি রহমত কা, বন্দে নাছিজ নাজির তেরা/ তু বহরে করম হ্যায় নন্দলালা– এয়ে সাল্লে আলা, আল্লাহ্ গণি– আল্লাহ্ গণি।’ তাঁর এই কাব্যে ৩২টি ভার্স রয়েছে, যেখানে কৃষ্ণের ঐশ্বর্য এবং মাধুরী উভয়ই বর্ণিত।

আরও পড়ুন
নবাবি কলমে রাধাকৃষ্ণের কিস্‌সা, নর্তকীর বেশে হোলি উদযাপন ওয়াজেদ আলি শাহের

নবাবদের শেষ উত্তরাধিকারী ওয়াজিদ আলি শাহ (Wajid Ali Shah) ১৮৪৩-এ রাধা-কৃষ্ণের উপর একটি নাটক রচনা করেন। লখনউয়ের ইতিহাসের ইতিহাসবিদ রোজি লেভেলিন জোনস ‘দ্য লাস্ট কিং অব ইন্ডিয়া’তে লিখেছেন, তিনিই প্রথম মুসলিম রাজা (নবাব) যিনি রাধা-কৃষ্ণের উপর নাটকটি পরিচালনা করেছিলেন। লেভেলিন বলেছেন, ওয়াজিদ আলি শাহ কৃষ্ণের জীবন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ওয়াজিদের অনেক নামের মধ্যে একটি ছিল ‘কানহাইয়া’। তাছাড়াও উল্লেখ করা যেতে পারে মওলানা হাসরত মোহানির নাম। মোহানি প্রায়ই জন্মাষ্টমী উদযাপন করতে মথুরায় যেতেন। এমনই জানিয়েছেন সি এম নইম নামে একজন বিখ্যাত উর্দু পণ্ডিত। কৃষ্ণের প্রশংসা করে এবং কোনও এক জন্মাষ্টমীতে মথুরায় না থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মোহানি লিখেছেন— ‘হাসরত কি ভি কুবুল হো মথুরা মে হাজিরি, শুনতে হ্যায় আশিকো পে তুমহারা করম হ্যায় খাস (মথুরায় আপনিও হাসরতকে গ্রহণ করুন— আমি শুনছি প্রেমীদের প্রতি আপনি বিশেষভাবে দয়ালু)। আরেকজন বিশিষ্ট কবি হাফিজ জলন্ধরি (১৯০০-১৯৮২), যিনি দেশভাগের পর লাহোরে চলে আসেন। তিনি শুধু পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত ‘কওমি তারানাহ’ রচনার জন্যই বিখ্যাত নন, তাঁর মূল্যবান উর্দু কবিতা ‘কৃষ্ণ কানহাইয়া’র জন্যও বিখ্যাত। এভাবেই মুসলিম সাহিত্যিকরা সম্প্রীতির উলকাঁটায় বেঁধেছেন তাঁদের সৃষ্টিকে।

এসব তো গেল অবাঙালিদের কথা। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই, প্রচুর বাঙালি মুসলমান কবি রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে লিখেছেন পদাবলি। এমনকি বাদ যায়নি গৌরাঙ্গের কথাও। বাংলাতে চৈতন্য পরবর্তী যুগে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের কলমেও লেখা হয় অসংখ্য পদাবলি। বাউল ফকিরদের গানেও মিশে গেছে প্রেম আর ভক্তির বিবিধ রূপ। যা আসলে সুফি-সমন্বয়বাদী ধারারই প্রতিফলন। এভাবেই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে যায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাথা। সমৃদ্ধ করে বাংলার জীবন ও সমাজকে। 

Powered by Froala Editor