নিছক লৌকিক দেবী নন, ষষ্ঠীর কথা রয়েছে শাস্ত্রেও

সেদিন মাঘ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী, বেজায় ঠান্ডা আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বামুনবাড়ির এক বৃদ্ধা ঠাকুমা নাতবৌদের ডেকে বললেন, আজ গরম জলে চান করবেন, খাবেন গরম ভাত। নাতবৌরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে করতে দিদিশাশুড়ির কথা অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করে দিল বটে, কিন্তু তার ফল হল মারাত্মক। পরেরদিন সকালে উঠে ঠাকুমা দেখলেন, বাড়িশুদ্ধু সকলে মৃতকল্প অবস্থায় পড়ে আছে। কেন? শীতলষষ্ঠীতে বাড়ির উনুন অবধি ধরাতে নেই, গরম ভাত খাওয়া তো দূরের কথা। সেই নিয়ম ভঙ্গ করার ফলেই নেমে এসেছে দেবীর কোপ।

দেবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে, প্রায়শ্চিত্ত করে তবে আবার নিজের পরিবারের মানুষদের ফিরে পেয়েছিলেন সেই বৃদ্ধা। এমনই এক নির্মম দৈবরোষের কাহিনি জড়িয়ে আছে শীতলষষ্ঠী ব্রতের সঙ্গে। তাই ধর্মভীরু পরিবারে এদিনের আহার পান্তাভাত, গোটাসেদ্ধ আর দই। সেইসঙ্গে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা। সরস্বতীপুজোর পরের দিনটি এভাবেই উদযাপন করেন বাংলার মানুষ। 

শিশু সন্তানদের রক্ষার্থে মা ষষ্ঠীর (Devi Shashthi) ব্রত বাংলার নারীসমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। অনেকেরই ধারণা, ষষ্ঠী হলেন এক অর্বাচীন তথা লৌকিক দেবী। কিন্তু সত্যিই কি তাই? একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক। 

বেদের সংহিতা অংশে অগ্নিজাতক দেবতা স্কন্দের কথা একাধিকবার উল্লিখিত৷ ষড়বেদাঙ্গের অন্যতম 'কল্প' সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত অগ্নিবেশ্য গৃহ্যসূত্র, কঠক গৃহ্যসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থে স্কন্দ ও স্কন্দপত্নী ষষ্ঠীর উপাসনার বিধি মিলবে। আর দেবী ষষ্ঠীর স্বতন্ত্র উপাসনাবিধি মেলে 'মানব গৃহ্যসূত্র' গ্রন্থে। এই উপাসনাবিধির নাম 'ষষ্ঠীকল্প'। সেখানে বলা হচ্ছে, প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করে পরদিন, অর্থাৎ ষষ্ঠী তিথিতে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা কর্তব্য। এই উপাসনার মন্ত্র কীরূপ? একটু উদাহরণ দেওয়া যাক।

আরও পড়ুন
ষাইট ষষ্ঠী ষাইট…

স্কন্দ এবং বিশাখের মধ্যস্থা দেবী ষষ্ঠী, দ্বিতীয় শতক। কুষাণ যুগের ভাস্কর্য। মথুরা মিউজিয়ামে রক্ষিত। 


আরও পড়ুন
‘আমার দুর্ভাগ্য, মরার বয়সে পাণ্ডব গোয়েন্দার এই পরিণতি দেখে যেতে হল’ : ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

 

আরও পড়ুন
শ্বশুরমশাইয়ের চোয়াল নাকি ‘ঘোড়ার মতো দীর্ঘ’, হিসেব কষে ষষ্ঠীতে যেত জামাই

ধনদাং বসুমিশানাং কামদাং সর্বকামিনাং।
পুণ্যাং যশস্বিনীং দেবীং ষষ্ঠীং শক্র যুজস্ব মে।।

ষষ্ঠী দেবীর নিকটে পুত্র, পশু, ধন, ধান্য আদি সার্বিক সমৃদ্ধির কামনায় এই উপাসনা। এই ষষ্ঠীকল্পের মধ্যে বৈদিক শ্রীসূক্তের একাধিক মন্ত্র প্রযুক্ত হয়েছে, এবং 'শ্রী', 'লক্ষ্মী' প্রভৃতি নামাবলীর উল্লেখ আছে। অর্থাৎ অনুমান করা চলে, গৃহস্থের সার্বিক কল্যাণের জন্য কৃত ষষ্ঠী-উপাসনা ও লক্ষ্মী-উপাসনার মধ্যে সেকালে একটা নিকটসম্বন্ধ ছিল, যে নৈকট্যের সাক্ষ্য পরবর্তীকালে মহাভারতে আবারও পাওয়া যাবে৷ 

গবেষকদের মতে মানব গৃহ্যসূত্রের সম্ভাব্য সংকলন-কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ বা পঞ্চম শতকেরও আগে। অর্থাৎ বৈদিক বা শ্রৌত পদ্ধতিতে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা এ দেশে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন। কালের নিয়মে এই পূজার রীতিনীতিতে অজস্র বদল এসেছে, এবং বর্তমানে বাংলার নারীসমাজে প্রচলিত ষষ্ঠী-উপাসনা বিধি তেমনই এক সুপ্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতির অনুবর্তন, কোনওভাবেই তা অর্বাচীন বা লৌকিক কোনো অভ্যাস মাত্র নয়৷ বৈদিক সাহিত্যে যা ছিল 'ষষ্ঠীকল্প', বাংলার নারীসমাজে তাই হয়েছে 'ষষ্ঠীব্রত'। শ্রৌত আচারের স্থানে এসেছে স্ত্রী-আচার, শ্রুতিমন্ত্রের স্থান নিয়েছে আঞ্চলিক ভাষার প্রায়োগিক ছড়া, যার পোশাকি নাম শাবর মন্ত্র। প্রতি মাসের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে দেবীর উপাসনার সংস্কৃতি এইভাবে বাংলার মাতৃসমাজে সজীব আছে, আর নতুন নামও পেয়েছে৷ বৈশাখে ধূলাষষ্ঠী, জ্যৈষ্ঠে অরণ্যষষ্ঠী (নামান্তরে জামাইষষ্ঠী), আষাঢ়ে কোড়াষষ্ঠী, শ্রাবণে লোটনষষ্ঠী, ভাদ্রে মন্থনষষ্ঠী, আশ্বিনে দুর্গাষষ্ঠী, কার্তিকে গোটষষ্ঠী, অগ্রহায়ণে মূলাষষ্ঠী, পৌষে পাটাইষষ্ঠী, মাঘে শীতলষষ্ঠী, ফাল্গুনে অশোকষষ্ঠী এবং চৈত্রে নীলষষ্ঠী— বারো মাসের বারো ষষ্ঠীতে নামের বৈচিত্র্য যেমন, পূজাপদ্ধতির বৈচিত্র্যৈও কিছু কম নয়! 

আচ্ছা, কথা বলে ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে’। মহাভারতে ষষ্ঠী ঠাকুরাণীর কথা কদ্দূর কী আছে, একটু দেখা যাক। 

দক্ষিণ ভারতে পূজ্য স্কন্দস্বামী। দক্ষিণে বল্লী, বামে ষষ্ঠী।


 

মহাভারতের বনপর্বে অগ্নি ও স্বাহার পুত্র স্কন্দদেবের বিস্তারিত কাহিনি পাওয়া যায়। সেখানে দেখি, মাঘমাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী ও ষষ্ঠী— দুটিই কার্তিকঠাকুরের জীবনের বিশেষ সন্ধিলগ্ন, দুইরকমভাবে তাঁর 'দেবসেনাপতি' হয়ে ওঠার দিন। কীভাবে? পঞ্চমী তিথিতে ইন্দ্র তাঁর জ্ঞাতিভগিনী দেবসেনা ওরফে ষষ্ঠীকে কার্তিকের করে বধূরূপে সম্প্রদান করলেন, কার্তিক হলেন দেবসেনাপতি। এই ষষ্ঠীরই নামান্তর শ্রী তথা লক্ষ্মী (পাঠক, মানবগৃহ্যসূত্র স্মরণ করবেন)। তাই কার্তিকের জীবনে লক্ষ্মীরূপা বধূ ষষ্ঠীর শুভাগমনের দিনটিই মহাভারতে 'শ্রীপঞ্চমী' নামে চিহ্নিত। এবং, ষষ্ঠী তিথিতে কার্তিক দেবতাদের সৈনাধ্যক্ষ পদে অভিষিক্ত হলেন, তাই এই তিথি 'মহাষষ্ঠী' নামে খ্যাত। এ হলো আরও একবার স্কন্দের দেবসেনাপতি হয়ে ওঠার দিন। 

এই যে স্কন্দগৃহিণী ষষ্ঠী, যিনি পূর্বে সার্বিক সমৃদ্ধির আশায় পূজিতা হতেন, তিনি বিশেষভাবে শিশুরক্ষাকারিণী দেবীতে পরিণত হলেন কীভাবে? তারও একটা সম্ভাব্য উত্তর মহাভারতের বনপর্বে মিলবে। একদা বালক কার্তিকের প্রচণ্ড পরাক্রম দেখে ঈর্ষান্বিত এবং শঙ্কিত দেবতারা লোকমাতাদের প্রেরণ করেন স্কন্দবধের উদ্দেশ্যে। বিভিন্ন উপায়ে শিশুহত্যাই এই লোকমাতাদের কাজ। কিন্তু স্কন্দের কাছে এসে তাঁরা স্কন্দকে সন্তানরূপে বরণ করলেন, স্কন্দও তাঁদের মাতৃস্নেহকে স্বীকৃতি দিলেন। এইভাবে, শিশুঘাতিনী লোকমাতা গোষ্ঠী স্কন্দের পরিবারভুক্ত হওয়ায়, শিশু-সুরক্ষার জন্য স্কন্দ তথা স্কন্দপত্নীর শরণ নেওয়া মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। তাই, দেবসেনা তথা ষষ্ঠী বিশেষভাবে শিশু-রক্ষয়িত্রী দেবী। দক্ষিণভারতে স্কন্দ-উপাসনা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। সেখানে কার্তিকের সঙ্গে পূজিত হন তাঁর দুই পত্নী— দক্ষিণে বল্লী, বামে ষষ্ঠী। 

বাংলার একটা বেশ বড়ো পরিসরের পাঠকগোষ্ঠীর ধারণা— ষষ্ঠী, মনসা, মঙ্গলচণ্ডী প্রভৃতি দেবতা আগে ছিলেন লৌকিক শ্রেণিভুক্ত, মধ্যযুগে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের রচয়িতা দু-চারটি করে দেবভাষার শ্লোক লিখে এঁদের শিষ্টসমাজে সম্মানের আসন দিয়েছেন। এবং মঙ্গলকবিরা আঞ্চলিক ভাষায় কাব্য লিখে আরও খানিক মর্যাদা বাড়িয়েছেন। এ ধারণা সমর্থনযোগ্য নয়। ব্রহ্মবৈবর্তে ষষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে— এই তথ্য থেকে বঙ্কিমচন্দ্র এই পুরাণটির অর্বাচীনতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। বাস্তবে ব্যাপারটা উল্টো— ষষ্ঠীর উল্লেখ থাকা মানে সেই গ্রন্থের অর্বাচীনতা প্রমাণিত হয় না, প্রমাণিত হয় যে খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে বেদানুগ ব্রাহ্মণ্য ধর্মে প্রচলিত ষষ্ঠী-উপাসনার একটি বিশেষ রূপ ধরা পড়েছে ব্রহ্মবৈবর্তে। তাই, এই পুরাণ অর্বাচীন বিষয় হাজির করছে না, বহুশতাব্দীবাহিত এক সুপ্রাচীন ধারার অনুবর্তন করছে মাত্র। 

কলকাতার বাগবাজারে মা ষষ্ঠীর প্রতিমা। 

 

ব্রহ্মবৈবর্তের প্রকৃতিখণ্ডে বলা হচ্ছে, রাজা প্রিয়ব্রতর মৃত পুত্র দেবী ষষ্ঠীর কৃপায় পুনর্জীবন লাভ করলে তিনি কৃতজ্ঞতাবশত দেবীর পূজা আরম্ভ করেন। দেবীর ধ্যানমন্ত্র, অষ্টাক্ষর মহামন্ত্র এবং স্তোত্রসহ বিস্তারিত পূজাপদ্ধতি এই পুরাণে রয়েছে৷


মধ্যযুগে স্মার্ত অনুষ্ঠানবিধির সংকলক রঘুনন্দন ভট্টাচার্য তাঁর 'অষ্টাবিংশতিতত্ত্বম্' গ্রন্থে বিভিন্ন উৎস থেকে ষষ্ঠীপূজার স্মার্ত বিধি সংকলন করেছেন। কৃষ্ণরাম দাস, রুদ্ররাম চক্রবর্তী, শঙ্কর প্রমুখ কবি রচনা করেছেন ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্য। এছাড়াও কৃত্তিবাস ওঝার 'শ্রীরাম পাঁচালী', বৃন্দাবন দাসের 'চৈতন্যভাগবত' প্রভৃতি গ্রন্থে জাতকের কল্যাণার্থে ষষ্ঠীপূজার উল্লেখ রয়েছে। 

লোচন দাস বিরচিত 'চৈতন্যমঙ্গল' গ্রন্থের আখ্যানটি খানিক অন্যরকম। লোচন দাস লিখছেন, একদিন শচী দেবী ষষ্ঠীব্রতের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য প্রস্তুত করে আঁচলে ঢেকে নিয়ে চলেছেন বটতলায়, সঙ্গে আছেন প্রতিবেশিনী নারীরা। এমন সময়ে শিশু নিমাইয়ের আগমনে মা ত্রস্ত, চঞ্চল গোরাচাঁদ আবার কী কাণ্ড ঘটায়। আর হলও তাই, মায়ের আঁচলে ঢাকা নৈবেদ্য কেড়ে নিল কৌতূহলী বালক, তারপর মধু ঘৃত গব্য আদি সবকিছু নিজের মুখে পুরে দিল। ক্রুদ্ধ ও শঙ্কিত মায়ের বকুনি শুনে নিমাই বলল, 

শুন অবোধিনী, আমি সব জানি, আমি তিন লোক সার।
জগতে যতেক, আমি মাত্র এক, ত্রিভুবনে নাহি আর।।
তরুমূলে যেন, জল নিষেচন, উপরে সিঞ্চিত শাখা।
প্রাণ নিষেচন, ইন্দ্রিয় যেমন, ঐছন আমার লেখা।।

মায়ের মন যেমনই করুক, গ্রন্থকার লোচন দাস নিমাইকে ‘সব দেবসার’ বলে স্তুতি করতে কার্পণ্য করেননি। শিশুর ক্রীড়াকৌতুকে কবির আনন্দ বেড়েছে বই কমেনি।

Powered by Froala Editor