ভালোবাসাই তাঁদের কাছে আসল ধর্ম; তবুও পূর্ণতা পেল না দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রেম

চল্লিশের দশক। ইংরেজ শাসনের শেষের সময়। নতুন কোনো আলোর প্রত্যাশায় মুখিয়ে আছে ভারতবাসী। এমন সময় অবিভক্ত পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার এক তরুণ চলে এলেন মুম্বইতে। নাম ধরমদেব পিশরিমাল আনন্দ। স্বপ্ন বলতে সামান্য একটি চাকরির, আর মাথা গোঁজার মতো একটি ঘরের। চার্চগেটের কাছেই ছিল মিলিটারি সেন্সর অফিস। সেখানেই মাসিক ৬৫ টাকা মাইনের চাকরিতে ঢুকলেন তিনি। সেদিন খানিক সময় পেয়েছিলেন হাতে। পাশের সিনেমা হলে চলে গেলেন বন্ধুদের সঙ্গে। তখন সেখানে চলছিল ‘অচ্ছুৎ কন্যা’, অভিনয়ে স্বয়ং ‘দাদামশাই’ অশোক কুমার। ধরমদেবের কেমন একটা ঘোর লেগে যায় সিনেমাটি দেখে। কী অসাধারণ অভিনয় অশোক কুমারের!

একটাতে মন ভরল না। কয়েকদিন পর আবারও একটা সিনেমা দেখতে গেলেন। এবারও অশোক কুমার। একটু একটু করে ধরমদেবের জগতটাও বদলে যাচ্ছিল। কেরানির চাকরিতে আর মন টিকছিল না। ততদিনে দাদা চেতন আনন্দও চলে এসেছেন মুম্বইতে। ধরমদেব ঠিক করলেন, এবার অভিনয়ের ময়দানে নামবেন। হঠাৎ করেই একদিন ছেড়ে দিলেন চাকরি। বলা ভালো, সেই দিনটি থেকে ভারতীয় সিনেমহল সাক্ষী থাকল এক কিংবদন্তির জীবনযাত্রার। ধরমদেব পিশরিমাল আনন্দের খোলস ছেড়ে জন্ম নিল নতুন এক পরিচয়— এক এবং অদ্বিতীয় দেব আনন্দ…

তাঁর নামের পাশে ‘এভারগ্রিন’ বা চিরকুমার শব্দটি বসে গেছে বরাবরের মতো। ২৩ বছর বয়সে শুরু হয়েছিল ফিল্মি কেরিয়ার। যতদিন বেঁচে ছিলেন, জীবনের মঞ্চে দাপিয়ে বেরিয়েছেন দেব আনন্দ। ধরা যাক ১৯৪৬-এর কথা। ভারতের ইতিহাসে ‘বড়ো সুখের সময়’ ছিল না সেটা। দেশভাগের দাবিতে উত্তাল গোটা দেশ। পাঞ্জাব আর বাংলায় চলছে দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলিম দুই পক্ষই মিত্রতা ভুলে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতেই তৈরি হল ‘হাম এক হ্যায়’। বিষয় ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও প্রেম। আর এমন পটভূমিতেই আবির্ভাব হল দেব আনন্দের।

সিনেমাটির কিছু অংশের শুট হয়েছিল পুনেতে। নবাগত দেব আনন্দ সবার সঙ্গে সেখানে গেলেন কাজে। কাজ করতে করতে আলাপ হল আরেকটি ছেলের সঙ্গে। তিনি অবশ্য সেই সিনেমায় অভিনয় করছিলেন না; শুটিং দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু অভিনয় করতে বরাবরই ভালোবাসেন। দেব দেখলেন, তাঁর চিন্তার সঙ্গে এই ছেলেটিরও ভাবনা মিলে যায়। বন্ধুত্ব গাঢ় হতে সময় লাগল না। এমনকি দুজনের মধ্যে অলিখিত শর্তও ছিল, যদি ভবিষ্যতে তাঁরা সিনেমায় দাঁড়াতে পারেন, তাহলে একে অপরকে সাহায্য করবেন। কথা রেখেছিলেন দুজনেই। ছেলেটির নাম? গুরু দত্ত…

‘হাম এক হ্যায়’ সেভাবে মনে রাখেনি কেউ। কিন্তু এর জেরে ‘গুরু’ অশোক কুমারের নজরে পড়ে যান দেব আনন্দ। ঠিক দুই বছর পর, তাঁরই দৌলতে দেব আনন্দ চলে আসেন বম্বে টকিজে। ১৯৪৮ সাল। শাহিদ লতিফের পরিচালনায় মুক্তি পেল ‘জিদ্দি’। নায়ক হিসেবে প্রথমবার সামনে এলেন দেব আনন্দ। উল্লেখ্য, এই একই সিনেমা থেকেই বলিউডে নিজের সুরেলা যাত্রা শুরু করেছিলেন কিশোর কুমার। ‘জিদ্দি’ থেকেই শুরু হল এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। বলিউড তো বটেই, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতও পেল তার প্রিয় ‘দেব সাব’কে। তার চিরবসন্তের দূতকে…

গায়ে জ্যাকেট, গলায় মাফলার, আর মাথায় একটি টুপি— হিন্দি সিনেমায় একটা ঝলমলে, ফ্ল্যাম্বয়েন্ট নায়কের যুগ শুরু হল। দেব আনন্দের এমন ‘মস্তানি’ই ঝড় তুলল আপামর ভারতের মনে। আর সেখানেই হাজির হলেন একজন— সুরাইয়া। ‘বিদ্যা’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন দুজনে। একবার শুটিংয়ের জন্য নৌকা করে যাচ্ছিলেন নায়ক-নায়িকা। গান চলছে ‘কিনারে কিনারে’। হঠাৎ চিৎকার! ইউনিটের লোকেরা দেখলেন, নৌকাটি প্রায় উল্টে পড়ে যাচ্ছে। আর নদীতে কোনোক্রমে মাথা তুলে আছেন সুরাইয়া। এক মুহূর্ত দেরি করলেন না নায়ক দেব আনন্দ। নিজে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচান সুরাইয়াকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই।

ওই দুর্ঘটনা থেকেই শুরু হল অন্য এক গল্প। দেব আনন্দ আর সুরাইয়ার প্রেমের গল্প। দেব সাবের জীবনটাই ছিল এক আস্ত রঙ্গমঞ্চ। এই পর্বটিও কোনো চিত্রনাট্যের থেকে কম ছিল না। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১— চার বছরে সাতটি ছবি মুক্তি পায় দুজনের। ধীরে ধীরে দেব-সুরাইয়ার প্রেমের গল্প বলিউডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সব শুরুরই কি সুন্দর শেষ থাকে? ভিন ধর্মের এক ছেলের সঙ্গে কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজিই ছিলেন না সুরাইয়ার দাদি। পরিবারে তাঁরই সবচেয়ে বেশি কর্তৃত্ব ছিল; আর তাঁকে এড়িয়ে এমন কাজ করতে পারতেন না সুরাইয়া। তাও সবসময় দুজনে এক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। দেব আনন্দের কাছে তখন ‘ভালোবাসার থেকে বড়ো ধর্ম নেই’। কিন্তু, সব ব্যর্থ। একদিন গভীর রাতে সুরাইয়ার বাড়ি চলে গেলেন দেব। সে-ই ছিল শেষ আলাপ, কাছে আসা। থেমে গেল আরও এক প্রেমের উপাখ্যান। সুরাইয়াও এরপর চলে যান আড়ালে। চিরজীবন অবিবাহিতা থেকে যান। কেমন সিনেমার মতো মনে হচ্ছে না?

দেব আনন্দ ছিলেন এরকমই। ভারতীয় সিনেমার ‘গ্রেগরি পেক’। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়; তাঁর হাত ধরে জিনাত আমন, হেমা মালিনীর মতো ভবিষ্যতের তারকারাও উঠে এসেছেন। নিজে পর্দায় থাকুন বা না থাকুন; চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত। অনেকেই বলেছিলেন, শেষ কিছু সিনেমা না করলেই বোধহয় ভালো ছিল। বক্স অফিসে সেভাবে চলেওনি। কিন্তু দেব আনন্দ তো টাকা রোজগারের জন্য সেই সিনেমা করেননি! চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তো তিনি চিরস্থায়ী আসনও পেয়ে গেছেন ততদিনে। সেগুলো করেছিলেন; কারণ সিনেমা ছাড়া দেব আনন্দ অসম্পূর্ণ। উল্টোটাও যে একইভাবে সত্যি! চিরতরুণকে বুকে না রাখলে, কীভাবে আরও অক্সিজেন পাব আমরা? ‘দেব সাব’ হলেন সেই অক্সিজেন, তাজা এক বাতাস। ভারতীয় সিনেমার ফ্ল্যাম্বয়েন্ট হিরো…

তথ্যসূত্র-
১) ‘ব্যর্থ পালিয়ে বিয়ের চেষ্টা, লুকিয়ে দেখা ছাদে, বিয়ে অবধি গড়ায়নি দেব আনন্দ-সুরাইয়া সম্পর্ক’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘দেব আনন্দ: বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম সফল অভিনেতা’, নিউজ জি ২৪
৩) ‘Remembering Dev Anand on his 96th birthday: Dev Anand as I knew him’, Subhash K Jha, National Herald

Powered by Froala Editor

More From Author See More