১৯০৮ : পৃথিবীর বুকে ভয়ঙ্কর উল্কাপাত, বিলুপ্ত হতে পারত মানব সভ্যতাও

আজ থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগের কথা। পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল আনুমানিক ১০ কিলোমিটার ব্যাসের প্রকাণ্ড এক উল্কাপিণ্ড। আর সেই আঘাতেই পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছিল দৈত্যাকার ডাইনোসরদের অস্তিত্ব। যদিও মতান্তরে ও আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী একটি নয়, ওই প্রকাণ্ড আকারের দুটি উল্কাপিণ্ড বা গ্রহাণু সে-সময় খসে পড়েছিল পৃথিবীর ওপর। কতটা ব্যাপক ছিল সেই ধ্বংসলীলা?

আজ প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের দৌলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নতুন করে ডিজিটালি রিক্রিয়েট করা হয়েছে প্রকৃতির সেই ধ্বংসলীলাকে। তবে এত ব্যাপকমাত্রায় না-হলেও, এমনই এক প্রকাণ্ড উল্কা খসে পড়ার দৃশ্য সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল আধুনিক সভ্যতারও। তুঙ্গুস্কা ইভেন্ট নামে পরিচিত সেই মহাজাগতিক ঘটনার বীভৎসতা পারমাণবিক বিস্ফোরণের থেকেও কম ছিল না কোনো অংশে। 

ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ছিল ১৯০৮ সালের ৩০ জুলাই। সাইবেরিয়ায় (Siberia) স্থানীয় সময় অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৭টা বেজে ১৪ মিনিট। কেউ বাজার করতে বেরিয়েছেন পায়ে হেঁটে। কেউ আবার সবে চুমুক দিয়েছেন চায়ের কাপে, খুলেছেন খবরের কাগজ। হঠাৎ-ই আকাশ চিরে খসে পড়ে আগুনের লেলিহান রেখা। যেন মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করছে কোনো ফিনিক্স। তারপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ৫.০ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল গোটা শহর। সেইসঙ্গে কানের পর্দা ফাটানো আওয়াজ। সাইবেরিয়ার চরম শীতেও, বিস্ফোরণের হলকায় পশমের জামা-কাপড় খুলে ফেলেন অনেকেই। এমনকি বিস্ফোরণের দমকে কয়েকশো মাইল দূরে অবস্থিত কানস্ক শহরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রেল চলাচলও। 

না, শুধু রাশিয়াতেই নয়। এই বিস্ফোরণের আঁচ পড়েছিল সুদূর ইংল্যান্ডেও। প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লন্ডনের ব্যারোমিটারে আকস্মিক বেড়ে গিয়েছিল বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিমাণ। অন্যদিকে এই বিস্ফোরণের মূল ঘটনাস্থল, টাঙ্গুস্কা পরিণত হয়েছিল জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। বিস্ফোরণের ফলে ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিল প্রায় ৮ লক্ষ গাছ। গলে গিয়েছিল বছর পর বছর ধরে জমে থাকা বরফ। পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরীয় হাওয়ায় সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা অঞ্চলে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চল থেকে নিকটবর্তী জনবসতির দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার হলেও, দ্রুত ফাঁকা করে দেওয়া হয় সেইসব গ্রামগুলি। 

অবশ্য আজ মহাকাশ থেকে খসে পড়া উল্কা বা গ্রহাণুকে দায়ী করা হলেও, সে-সময় সেই ধারণা ছিল না অধিকাংশ মানুষের মনেই। এমনকি তৎকালীন সময়ে সেভাবে কারণও অনুসন্ধান করা হয়নি এই ঘটনার। বা, বলা ভালো রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক পরিমণ্ডল এবং বড়ো প্রাণহানির ঘটনা না-ঘটার কারণেই উপেক্ষা করা হয়েছিল এই ঘটনাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব— সবমিলিয়ে এই অস্থির সময়ে সম্পূর্ণভাবে ধামাচাপা পড়ে যায় এই বিস্ফোরণের কথা। 

এই ঘটনার প্রায় ১৩ বছর পর গবেষণায় নামেন সেন্ট পিটার্সবার্গ মিউজিয়ামের গবেষক এবং উল্কা সংগ্রাহক ভ্লাদিমির কুলিক। বিশেষ গবেষক দল গঠন করে তিনি একাধিকবার অনুসন্ধান চালান টুঙ্গুস্কার (Tunguska) গোটা ধ্বংসক্ষেত্রে। এই দুর্ঘটনার পর দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও সেখানে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়নি— এই ঘটনা আশ্চর্য করেছিল কুলিককে। পাশাপাশি গোটা অঞ্চলে তদন্ত করেও মেলেনি গ্রহাণুর কোনো ধ্বংসাবশেষ, লোহা ও অন্যান্য ধাতুর আকরিক এবং প্রস্তরখণ্ড। পাহাড়ের ওপর থেকে পর্যবেক্ষণ করার সময়ও উল্কা খসে পড়ার দরুন তৈরি হওয়া কোনো বড়ো গর্তের দেখা পাননি তিনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রশ্ন তোলেন তবে সত্যিই কি এই দুর্ঘটনার কারণ কোনো মহাজাগতিক উল্কাপিণ্ড? 


সেই শুরু। ১৯৩০-এর দশক থেকে তারপর একে একে উঠে এসেছে একাধিক কনস্পিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কেউ দাবি করেছেন, এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে ভিনগ্রহীদের আক্রমণ। কেউ আবার ধরে নিয়েছিলেন, নিকোলা টেসলার তৈরি মারণাস্ত্র ‘ডেথ-রে’-র পরীক্ষামূলক ব্যবহারেই এই প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ হয়েছিল রাশিয়ার জনহীন প্রান্তরে। তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এফ.জে.ডব্লু হুইপেলের প্রস্তাবিত ‘কমেট থিওরি’-কে। হুইপেলের কথায়, এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ছিল আদতে একটি ধূমকেতু। ধূমকেতু সাধারণত তৈরি হয় ধূলিকণা এবং বরফের মাধ্যমে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর, বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছিল এই ধূমকেতুটি। তারপর মাটি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উচ্চতাতেই বিস্ফোরণ হয় তার। ফলে, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল জ্বলন্ত ধূলিকণা। তাতে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়লেও মাটির ওপর গর্ত তৈরি হয়নি কোনো। ২০১৩ সালে ইউক্রেনের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের বিজ্ঞানী ভিক্টর কাভাসন্সিয়েস্ট ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু পাথরের মাইক্রোস্কোপিক নমুনাও খুঁজে পান। তাঁর বিশ্লেষণ এই তত্ত্বকেও জোরদার করেছিল আরও। তবে এখানেই শেষ নয়। পৃথিবীর পদার্থ এবং মহাকাশ থেকে আগত পরাপদার্থ বা অ্যান্টিম্যাটারের সংঘর্ষে এই বিস্ফোরণ ঘটেছিল বলেও মনে করেন অনেকে। কেউ মনে করেন, সংস্লিষ্ট অঞ্চলে বিস্ফোরিত হয়েছিল মিথেনের কোনো গোপন খনি। কিন্তু কে আগুন লাগাল সেই খনিতে? সাইবেরিয়ার মতো হিমশীতল অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে আগুন লাগারও যে উপায় নেই কোনো। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না কোনো। 

তবে এই বিতর্কের বাইরে গিয়ে গ্রহাণু বা ধূকমেতু তত্ত্বকেই যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে সেই হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে খসে পড়া অবাঞ্ছিত আগন্তুকটির আয়তন ছিল প্রায় ৮০ মিটার দীর্ঘ একটি বলের সমান। আর তার জন্যই প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ২৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের অঞ্চল বা কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার জমি। আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী, এই বিস্ফোরণের প্রাবল্য ছিল হিরোশিমার পারমাণবিক বিস্ফোরণের থেকেও ১০০০ গুণ বেশি। ফলে, সাইবেরিয়া না-হয়ে অন্য কোনো জনবহুল অঞ্চলে এই বিস্ফোরণ ঘটলে প্রাণ হারাতেন কয়েক লক্ষ মানুষ। 

এবার ফিরে যাওয়া যাক ডাইনোসরদের কাহিনিতে। যেখানে এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী মাত্র ৮০ মিটার ব্যাসের একটি গ্রহাণু, সেখানে ডাইনোসরদের যুগে পৃথিবী আঘাত হেনেছিল যে উল্কাটি তার ব্যাস ছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার। ফলে, কতটা বীভৎস ছিল সেই বিস্ফোরণ, তা সহজেই আন্দাজ করা যায় এই ঘটনা থেকে। বর্তমানে বিশেষ মহাকাশযান কিংবা পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে উল্কাপিণ্ডের গতিপথ পরিবর্তনের প্রযুক্তি হাতে এসেছে গবেষকদের। যদিও সেই উল্কার ব্যাস যদি ১০ কিলোমিটার হয়, তবে সেক্ষেত্রে মানবসভ্যতার নিস্তার নেই কোনো।

Powered by Froala Editor