১৯৯৯ সাল। প্রথমবারের জন্য আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসে তালিবান গোষ্ঠী। আতঙ্ক ছিলই। যেমন আফগানিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার আশঙ্কা যেমন ছিল, তেমনই ছিল সে দেশের ইতিহাস বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও। তবে সবাইকে অবাক করে তালিবান সংস্কৃতিমন্ত্রী জানালেন, আফগানিস্তানের প্রাক-ইসলামিক পর্বের সমস্ত স্থাপত্যও সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হবে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবের মধ্যে তো ফারাক থেকেই যায়। মাত্র ২ বছরের মধ্যে কাবুল শহরে ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা। পৃথিবীর বৃহত্তম যুগল বুদ্ধমূর্তি ভেঙে ফেলল তালিবান বাহিনী। শুধু তাই নয়, এই ধ্বংসলীলার পক্ষে যাবতীয় যুক্তিও পেশ করতে থাকেন তাঁরা।
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি। আনুমানিক ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গান্ধার ভাস্কর্যের আদলে তৈরি হয় এই দুই মূর্তি। একদিকে একটি ৩৮ মিটার উঁচু মূর্তি, আর তার ঠিক উল্টোদিকে আরও বৃহৎ একটি মূর্তি। তার দৈর্ঘ্য ৫৫ মিটার। যদিও ইউরোপীয় পর্যটকরা আফগানিস্তানে আসার আগে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্তরে এই দুই মূর্তিকে নিয়ে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ১৮৩২ সালে আলেকজান্ডার বার্নেস প্রথম কাবুল শহরে এই বুদ্ধমূর্তির সন্ধান পান, বলা ভালো আবিষ্কার করেন। কিন্তু তাঁর কাছে দুটি মূর্তির কোনোটাই সৌন্দর্যের নিরিখে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে পরের বছরই বার্নেসের বক্তব্যকে একেবারে নাকোচ করে রিপোর্ট লিখলেন ভারতীয় সেনাবিভাগের সদস্য চার্লস ম্যাসন। সেই থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণা তো লেগেই রয়েছে, সেইসঙ্গে প্রতি বছর কয়েক হাজার পর্যটক ভিড় জমাতেন কাবুল শহরে।
বামিয়ানের এই বুদ্ধমূর্তি থেকে এটুকু বোঝা যায়, একসময় এই অঞ্চলে কোনো বৌদ্ধ উপসম্প্রদায় বাস করত। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রা বা ধর্মবিশ্বাস ঠিক কেমন ছিল, তা নিয়ে তেমন কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। বরং আফগানিস্তানের ইসলাম সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছেই এই মূর্তি বেশি আপন ছিল। তাঁরা এই যুগল মূর্তির একটিকে পুরুষ এবং একটিকে স্ত্রী হিসাবে মনে করতেন। এবং এই দুই মূর্তি হল আসলে লত এবং মানত। যাঁদের উল্লেখ আছে কোরান শরীফেই। তবে ইসলাম ধর্ম তো মূর্তিপূজার বিরোধী। কিন্তু লোকাচার আরর কবেই বা লিখিত ধর্মগ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ মেনে গড়ে ওঠে?
২০০১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জারি হল সেই ঐতিহাসিক ডিক্রি। তালিবান সরকার জানাল, যেহেতু আফগানিস্তানে একজনও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী নেই অতএব এই মূর্তিযুগলেরও কোনো তাৎপর্য নেই। বরং তা আফগানিস্তানের বর্তমান সংস্কৃতিকেই ক্ষতি করবে। সরকারের এই নির্দেশ অবশ্য মেনে নিতে পারেননি অনেক তালিবান সেনাও। একটু একটু করে তাঁদের বোঝানো হয়, এগুলো আসলে পাথর ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এই বিরাট মূর্তি ভেঙে ফেলা তো সহজ কথা নয়। শুধু শাবল-হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলা যাবে না। রকেট, ডিনামাইট সমস্তকিছু ব্যবহার করা হয়েছে এই দুই মূর্তি ভাঙতে। দুদিনের মধ্যে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। বামিয়ানের গুহা পড়ে রইল, থাকল না দুটি বুদ্ধমূর্তির একটিও।
আরও পড়ুন
বিনা বাধায় আফগান শহর দখল, তালিবানদের অগ্রগতিতে আশঙ্কার মেঘ
বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস নিয়ে নড়েচড়ে বসে ইউনেস্কোও। এমনকি শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি নানা দেশ থেকে এই মূর্তি কিনে নেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ততদিনে। গবেষকদের অবহেলায় ইতিহাসের অনেককিছুই অজানা থেকে গিয়েছে। সেই গবেষণার সূত্রটুকুও নেই আর।
আরও পড়ুন
রাস্তার ধারে বই বিক্রি থেকে বন্ধুত্ব, ভিন্নপথের দুই আফগানের গল্প
Powered by Froala Editor