১৬ জুন, ১৯২৫। আকস্মিকভাবে চলে গেলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার পর গেছিলেন দার্জিলিং। সেখানেই আচমকা মৃত্যু এসে পাশে দাঁড়াল। গোটা দেশের কাছেই সে বিরাট দুঃসংবাদ। সেই আঘাতকে ভাষায় বুনলেন রবীন্দ্রনাথ– ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ / মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ দু’লাইনের ছোট কবিতাতেই শ্রদ্ধা জানালেন দেশবন্ধুকে।
আরও পড়ুন
ট্রামের ঘণ্টাও শুনতে পাননি জীবনানন্দ, মৃত্যুর আগে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন একটা
নজরুল কিন্তু এত অল্পে থামেননি। আত্মীয়বিয়োগের ব্যথা তাঁর। দেশবন্ধুর মৃত্যুর খবর পেয়ে, পরেরদিন অর্থাৎ ১৭ জুন সকালেই লিখলেন একটি গান, নাম ‘অর্ঘ্য’ –
হায় চিরভোলা! হিমালয় হতে
অমৃত আনিতে গিয়া
ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের
মৃত্যু গরল পিয়া!আরও পড়ুন
সরস্বতী পুজো ঘিরে বিতর্কে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষ, চাকরি খোয়ালেন জীবনানন্দ
দার্জিলিং থেকে যখন কলকাতায় আনা হচ্ছিল দেশবন্ধুর মরদেহ, তখন নৈহাটি স্টেশনে হুগলিবাসীরা শেষ শ্রদ্ধা জানান তাঁকে। রজনীগন্ধার মালার সঙ্গে, চিত্তরঞ্জনের মৃতদেহের ওপর নিবেদিত হয় নজরুলের ‘অর্ঘ্য’ গানটিও।
আরও পড়ুন
ট্রামের ঘণ্টাও শুনতে পাননি জীবনানন্দ, মৃত্যুর আগে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন একটা
এর পরে, ২৫ জুন নজরুল লেখেন ‘ইন্দ্রপতন’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা। এই কবিতাটি পরবর্তীকালে বিতর্ক তৈরি করে মুসলমান সমাজে। নজরুল ৩০ জুন লেখেন আরেকটি কবিতা, ‘সান্ত্বনা’। আর, তাঁর বিখ্যাত রাজভিখারী’ গান, যেটি পরবর্তীকালে অন্তর্ভুক্ত হয় ‘সঞ্চিতা’ কাব্যসংকলনে, সেটি তিনি পরিবেশন করেছিলেন দেশবন্ধুর স্মরণে আয়োজিত এক শোকসভায়।
আরও পড়ুন
জীবনানন্দের প্রথম প্রেমিকার ‘মিথ’ নিয়ে আজও অমলিন বরিশালের লাল গির্জা
১৯২৫ অর্থাৎ যে-বছর দেশবন্ধু মারা গেলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন খ্যাতির শিখরে। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ‘গুরুদেব’ তিনি। তরুণ ও বিদ্রোহী কবি হিসেবে নজরুলের পরিচিতিও কিছু কম নয়। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে এই দু’জনের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
ঠিক সেই সময়ই, ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছিলেন আরেক কবি। তখনও তাঁকে প্রায় কেউই চেনে না। লেখালিখির বয়স বেশিদিন নয়, খ্যাতির তো প্রশ্নই নেই। অথচ ভবিষ্যতে তিনিই পরিচিত হবেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে। তিনি, জীবনানন্দ দাশ। হ্যাঁ, তিনিও একটি কবিতা লিখেছিলেন, চিত্তরঞ্জনের প্রয়াণ উপলক্ষ্যে।
যদিও সে-কবিতায় জীবনানন্দীয় কোনো সুবাসই পাবেন না পাঠক। প্রচলিত ধারায় লেখা এবং তৎসম শব্দের আধিক্য তাতে। জীবনানন্দ তখনও তাঁর কবিতার প্রকৃত সুর খুঁজে পাননি। অনেক সমালোচক বলেন, কবিতাটিতে নজরুলের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অংশবিশেষ রইল –
বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা
অশান্ত সন্তান ওগো, বিপ্লবিনী পদ্মা ছিল তব নদীমাতা।
কাল বৈশাখীর দোলা অনিবার দুলাইতে রক্তপুঞ্জ তব
উত্তাল ঊর্মির তালে-বক্ষে তবু লক্ষ কোটি পন্নগ-উৎসব
উদ্যত ফণার নৃত্যে আষ্ফালিত ধূর্জটির কন্ঠ-নাগ জিনি,
ত্র্যম্বক-পিনাকে তব শঙ্কাকুল ছিল সদা শত্রু অক্ষৌহিণী।
জীবনানন্দ তখন মূলত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায় লিখতেন। কিন্তু এই কবিতাটি তিনি পাঠালেন ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায়। বঙ্গবাণীর খানিক পরিচিতি ‘রাজনৈতিক পত্রিকা’ হিসেবেই। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস, যা ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়, প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গবাণীতেই। জীবনানন্দের ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয় বঙ্গবাণীর বিশেষ চিত্তরঞ্জন সংখ্যায়। পরবর্তীকালে নিজের প্রথম বই ‘ঝরা পালক’-এও কবিতাটি রেখেছিলেন জীবনানন্দ।
যাইহোক, বঙ্গবাণীতে কবিতা প্রকাশের পর, পত্রিকাটির একটি কবি বরিশালে মা কুসুমকুমারী দেবীর কাছে পাঠান জীবনানন্দ। কুসুমকুমারী কিন্তু খুব একটা খুশি হননি, ছেলে চিত্তরঞ্জনকে নিয়ে লিখেছে দেখে। চিঠিতে ছেলেকে লেখেন, ‘চিত্তরঞ্জন সম্পর্কে লিখেছ ভালোই করেছ। কিন্তু রামমোহনের ওপর লিখতে বলেছি তোমাকে, মহর্ষির ওপরেও।’
কুসুমকুমারী চাইছিলেন, মনীষীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লিখুন জীবনানন্দ। কিন্তু কবি সে-পথে হাঁটেননি। পরবর্তীকালে বরিশালে গেলে, মায়ের সঙ্গে এ নিয়ে তর্কও হয় তাঁর। মা’কে মুখের ওপর বলেছিলেন, ‘আমি ঐসব মনীষীদের নিয়ে কবিতা লিখব না।’
এটা কি জীবনানন্দের চিত্তরঞ্জন-প্রীতির কারণে? নাকি তাঁর মানসিক গড়ন আস্তে আস্তে বাস্তববাদী হয়ে উঠছিল, সে-কারণেই সমসাময়িক ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উঠে এসেছিল কবিতাটি? কবিতার ‘গুরু’ মায়ের বিপক্ষে যেতেও দ্বিধা করেননি তিনি।
ভাবলে আশ্চর্য লাগে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ – এই তিন কবির কলমেই উঠে এসেছিল চিত্তরঞ্জনের প্রয়াণ। সত্যিই, ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ ছিলেন তিনি। কবিতাগুলিই তার প্রমাণ...
ঋণ - নজরুলের জীবন ও সাহিত্য / ডঃ সুশীল ভট্টাচার্য
একজন কমলালেবু / শাহাদুজ্জামান
Powered by Froala Editor