ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ শেষ করে দিচ্ছে শিশুর কোমল, সংবেদনশীল মন। ক্রমশ তাদের ঘিরে ফেলছে তীব্র অবসাদ। এই আশঙ্কাজনক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। সাধারণত, বায়ুদূষণের প্রভাবে ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের ফুসফুস, চোখ ও ত্বকের মতো মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে, অ্যালার্জি, অ্যাসমা ও ক্যানসারের মতো রোগের সৃষ্টি হয়। কিন্ত, বায়ুদূষণ যে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য অবনতির এক বিশেষ কারণ, এই চমকপ্রদ তথ্য প্রথম ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটির বৈজ্ঞানিক ডঃ কোল ব্রোকাম্প এবং ডঃ প্যাট্রিক রায়ান দীর্ঘ গবেষণা করে বিশ্ববাসীর সামনে আনলেন। তাঁদের গবেষণা বিখ্যাত ‘এনভায়ারমেন্টাল হেল্থ পারস্পেকটিভ’ গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
বৈজ্ঞানিকদের মতে, যে সমস্ত শিশুরা দৈনন্দিন ঘরের বাইরে, রাস্তায় ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণের শিকার, তাদের মধ্যে বিভিন্ন মানসিক জটিলতা ও অসুস্থতা দেখা যাচ্ছে। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু এবং ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোরদের মধ্যে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে দুশ্চিন্তা, অবসাদ ও আত্মহত্যা-প্রবণতা। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে যে সমস্ত শিশু ও কিশোর ঠিকমতো খাদ্য ও পরিপোষণ পায় না, বায়ুদূষণের প্রকোপে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপুষ্টি ও অবসাদগ্রস্থ শরীরে, বায়ুদূষণের প্রভাবে দেখা দেয় সিজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার-এর মতো মারাত্মক মানসিক অসুখ।
এখন প্রশ্ন হল, কীভাবে তীব্র বায়ুদূষণ শিশুদের মানসিক বিকারের কারণ হয়ে ওঠে? বৈজ্ঞানিকদের মতে, বায়ুদূষক(Air Pollutant) যেমন ধুলো, প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্যপদার্থের অসম্পূর্ণ দহনের ফলে উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস ও যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়ায় থাকে অতি সূক্ষ্ম কণিকা। এই কণিকাগুলি ‘স্মল পার্টিকুলেটম্যাটার পলিউশান’ (PM 2.5) নামেই পরিচিত। এই সমস্ত কণিকাগুলি আকারে ২.৫ মাইক্রনের কম হওয়ায়, এরা সহজেই নিশ্বাসের সঙ্গে মানবশরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এমনকি, এরা রক্তসংবহন পথে মস্তিস্কের কোষে পৌঁছে তাদের দ্রুত ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে শুরু হয় স্নায়ুপ্রদাহ জনিত অসুখ (Neuro Inflammatory Disorder)-যার থেকে জন্ম নেয় ভীতি, অবসাদ, দুশ্চিন্তা ও অন্যান্য জটিল মানসিক অসুস্থতা।
বর্তমান ভারতে বায়ুদূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক ভাবে ঊর্ধ্বমুখী। ভারতের বিভিন্ন বড় শহরগুলিতে মাত্রাধিক যানবাহন চলাচল করে। তাদের থেকে নির্গত ধোঁয়ায় ও বহুতল নির্মাণের স্থানের বায়ুস্তরে বিশেষ ভাবে থাকে PM 2.5, যা সহজে মাটিতে অধঃক্ষিপ্ত হয় না। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে শিশুর শরীরে প্রবেশ করছে সেই বিষ। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে, ব্যাপক জনসচেতনতা ছাড়া এই দূষণ রোধ করা সম্ভব নয়। ভারতে, যেখানে শিশুদের একটি বড় অংশ খাদ্যসমস্যা, অশিক্ষা, অপুষ্টির মতো একাধিক বড় সমস্যার সঙ্গে দিনের পর দিন লড়াই চালায় - সেখানে বায়ুদূষণমাত্রা কমিয়ে এনে তাদের শৈশবকালকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। দূষণমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার অঙ্গীকারই সুস্থ রাখবে ছোট্ট শিশুদের মন।