দেবতারা মুখ ধুতে আসেন যে হ্রদে

সারারাত ধরে ঝমঝম বৃষ্টি। জল ঢুকে আসছে তাঁবুর ভিতরে। স্লিপিং ব্যাগের নিচটা ভেজা ভেজা। ঠান্ডা বাড়ছে। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীত নামছে সুনসান উপত্যকায়। তাঁবুর ভিতরে অন্ধকার, আর বাইরেটা মহাশূন্য। পাহাড়ের ছায়া, গাছের ছায়া, মেঘের ঘন ছায়ায় রাত যে এত গভীর হয়ে উঠতে পারে-- আমাদের তা ধারণা ছিল না।

দেওরিয়া তালে আমাদের রাত্রিটা ছিল এমনি। মে মাসের গরমে অনেক ঝক্কি নিয়ে কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপেছিলাম। উত্তরাখণ্ডের এইসব জায়গায় ঢুঁ মারা আমাদের প্রথম। উত্তেজনার শেষ নেই। পাহাড়… সেই প্রথম ট্রেকিং-এ যাব। কত কী উদ্ভট কল্পনা যে মাথায়…

আরও পড়ুন
ঘোড়ার সহিস অর্জুন আর অলীক চৌখাম্বার গল্প

কলকাতা থেকে হরিদ্বার। লীলা মজুমদারের ‘নদীপথে’তে চিনেছিলাম তাকে। কিন্তু সেই চেনার সঙ্গে এই জানার বিপুল ফারাক। গঙ্গাকে ঘিরে লক্ষ-লক্ষ মানুষ। আর গঙ্গার ক্ষয়াটে চেহারা। উঁচু-হয়ে-ওঠা চড়া, বালিয়াড়ি। রুক্ষ মৃতপ্রায় কিছু গাছ। ব্রিজের পরে ব্রিজ, ধোঁয়া- হরিদ্বারকে দেখে মন খারাপ হল সবার।

পরের দিন উখিমঠ। রাস্তায় চোখে পড়েছে ভয়াবহ দাবানলে পুড়ে যাওয়া গাছগুলির মৃতদেহ। জঙ্গলের সে মৃত্যুদৃশ্য ভয়ঙ্কর। কিন্তু শহুরে মানুষ আমরা। বেশিক্ষণ মনখারাপ করে থাকতে পারি না। উখিমঠের বিকেলবেলায় আকাশের রেখায়-রেখায় পাহাড় খুঁজে পেয়ে আমরা দুঃখ ভুললাম। মেঘের থেকে চুঁইয়ে নামছে সূর্যের লাল রঙ, রাস্তার ধারে চেরপাইন। উখিমঠটাকেই তখন স্বর্গ বলে মনে হল।

তখনও বুঝিনি, আরও অলীক এক স্বর্গ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

পরদিন পৌঁছলাম সারিগ্রাম। দেওরিয়া তালের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু হবে এইখান থেকেই। আমাদের ৭ জনের দলে ৫ জনই ষাটোর্ধ্ব। পথে বৃষ্টি নামতে পারে। তাই সবারই গায়ে পলিথিনের পাতলা রেইনকোট। পাহাড়ের মুখে সংক্ষিপ্ত তোরণ। সেখানে দেওরিয়া তালের বিবরণ। ২৪৩৮ মিটার উচ্চতা ইত্যাদি। এরপর সংকীর্ণ পাহাড়ি পথ। পাকদণ্ডী। পাহাড় কেটে উঁচু উঁচু সিঁড়ি। আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা কখন বদলে গেছে কালো শামিয়ানায়। পাহাড় ঘিরে দীর্ঘশ্বাসের মতো মেঘ। আমরা তাড়াতাড়ি পা-চালাই। কিন্তু চড়াই ভেঙে এত দ্রুত ওঠাও মুশকিল। সমতলে হাঁটা-পা সঙ্গ দেয় না। জঙ্গল-ঘেরা, শিকড়বাকড়-ঘেরা পাহাড়ি বন্ধুরতার মাঝে হঠাৎই শুরু হল চাবুকের মতো বৃষ্টি। আকাশভাঙা। ঐ পলিথিনের ২০ টাকা দামের রেইনকোটকে সে পাত্তাই দেয় না।

কী আর করা, কোনোক্রমে পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট মন্দিরটায় পৌঁছলাম। অদ্ভুত সেই পাহাড়ি মন্দির। দেখতে কেদারের মন্দিরের মতোই। ভক্ত বলতে পূজারি নিজেই। আর তাঁর সঙ্গী একটি মেয়ে বাছুর। সে আমাদের দেখে ভয় পায়। অপেক্ষাই সার। বৃষ্টি কমে না। তাই নিয়েই ওঠা। ওপর থেকে যারাই নামেন, উৎসাহ দেন চুটিয়ে। এই তো আরেকটু… আর আমাদের আদর করে বৃষ্টি। ঠান্ডাও বাড়তে থাকে।

দেওরিয়া তালে পৌঁছলাম যখন, সন্ধে নেমে এসেছে চারপাশ কালো করে। না, হ্রদের মুখ তখনো দেখিনি। সামনের একটা চায়ের দোকানে তখন আগুন ঘিরে বসেছি। হুহু ঠান্ডা। সঙ্গে শুকনো কিচ্ছুটি নেই। বাকি জামাকাপড় সব নিচে সারিগ্রামের হোটেলঘরে। কে জানত এমন বিপদ…?

শরীরে খানিক বল সঞ্চয় করে এবার এগোলাম দেওরিয়া তালে। তাল ঘেঁষেই আমাদের তাঁবু। কেদার স্যাঞ্চুয়ারির গর্ভে এই তাল। সামনেই খোলা ব্যালকনি জুড়ে একটা আলগা আলো ঝুলে আছে আকাশে। মেঘ সরছে ধীরে ধীরে। গাইড বললেন, গত সাতদিনে চৌখাম্বা মুখ দেখাননি। আজও চান্স কম। আমরা মুখ ভার করে তাঁবু খাটানোয় হাত লাগাই। হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, মেঘ সরে গেছে। যেন যবনিকা টেনে সরিয়ে দিয়েছে কেউ। একটা সিঁদুরে আলোয় দেখা যাচ্ছে চৌখাম্বা, বান্দরপুচ্ছ, কেদার, মন্দানি পর্বতশৃঙ্গ। দেওরিয়া তাল জুড়ে তাদের ঘন ছায়া।

গাড়োয়াল রেঞ্জের এমন অলৌকিক দৃশ্য হয়ত দেওরিয়া তালেই সম্ভব। গাইডও অবাক। এ কী করে সম্ভব হল আজ! এমন আকাশভাঙা বৃষ্টির পরেও! চৌখাম্বা তখন শেষ আলোয় উজ্জ্বল। যেন আমাদের অবাক করে দিয়ে লাজুক হাসছে।

স্থানীয়রা বলেন, দেওরিয়া তালে নাকি দেবতারা মুখ ধুতে আসেন। এখানেই নাকি যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল পঞ্চপাণ্ডবের। মৃত ভাইদের রক্ষা করেছিলেন যুধিষ্ঠির।

রাত বাড়ল। আমরা সাতজন ছাড়া ত্রিভুবনে কেউ কোথাও নেই। আবার বৃষ্টি। শব্দও মারাত্মক। দেওরিয়া তালের পাশে আমরাও ঠিক তারই মতো নিশ্চুপ। যেন এই নিবিড় বন, সীমাহীন আকাশ- কারো যেন ঘুম না ভাঙে।

স্বর্গের ঘুম ভাঙে। আমাদেরও। বৃষ্টি নেই। সূর্যোদয়ের সঙ্গে একে-একে জেগে উঠছে চৌখাম্বা বান্দরপুচ্ছেরা। আলো ফুটতেই এগাছ-ওগাছ থেকে হিমালয়ী পাখিরা বেরোয়। আমাদের দেখে অবাক হয়ে থামে। হয়ত ভয় পায়। অবশ্য ঝগড়ুটে ম্যাগপাই যেন ইয়া-বড়ো ল্যাজ নিয়ে ঠুকরোতে আসে। ঠিকই করে। আমরা সেখানে বাস্তবিকই অনুপ্রবেশকারী। সেটা আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি কিছুক্ষণ পর। একদল বাঙালি পর্যটক, সকালে উঠেছে দেওরিয়া তালে। সঙ্গে ডাফলি। গোল হয়ে বসে চিৎকার করে গান “তোমায় হৃদমাঝারে রাখব…”। সমস্ত নীরবতা ততক্ষণে দুরমুশ।

নামার পথে ভয় নেই। রাস্তা পরিষ্কার। একদল জাপানিকে উঠতে দেখলাম নামার পথে। আশ্চর্য এটাই, আমাদের সারি গ্রাম নামার আগেই তারা পৌঁছে গেল সেখানে। একদৌড়ে পাহাড়ভাঙা আর কি।

নামার সময় ডিনামাইট ফাটিয়ে পাহাড় ভাঙার শব্দ। রাস্তা হবে। এখন বোধহয় গাড়িও যায়, নিশ্চিত নই। শুনলাম, ইদানিং সেখানে তাঁবু পড়ছে বেশ। একটা দুটো নয়, তিরিশ-চল্লিশটা। ঘেঁষাঘেঁষি তাঁবু। রাতের বেলা ক্যাম্পফায়ার। আরো বেশি হৃদমাঝারে রাখতে চাওয়ার অত্যাচার। স্বর্গকে তো আমরা স্বর্গ রাখতে শিখিনি। জানি না, ম্যাগপাইগুলো এখন কী করে…

প্লাস্টিকে কি ঢেকে গেছে চৌখাম্বার মুন্ডুটা? দেওরিয়া তালের জলে কীসের ছায়া, এখন? মানুষের?