স্মৃতি-হারানো মানুষদের জন্য ‘নকল’ গ্রাম নেদারল্যান্ডসে

আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে কোনো তফাৎ নেই নেদারল্যান্ডসের হগওয়ের (Hogewey)। তবে আয়তনে ছোটো, লোকজনও বেশ কম। যাদের মধ্যে অধিকাংশই বয়স্ক। সুন্দর, নিরিবিলি গ্রামটিতে শোনা যাবে না কোনো বড়ো গাড়ির শব্দ। নিস্তরঙ্গ জীবনে নেই কোনো অবাঞ্ছিত উৎপাত। গ্রামের মাঝখানে একটি ছোট্ট পার্ক। ঝরনার চারদিকে ঘিরে বেঞ্চগুলিতে রোজ বিকেলে অনেক বসন্তের গল্প জুড়ে দেয় বাসিন্দারা। এটুকুই সম্পদ হগওয়ের। কিন্তু যদি বলা হয় যে, এর পুরোটাই সাজানো, পুরোটাই ‘মেকি’, তাহলে বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হতে পারে। হ্যাঁ, ছবির মতো এই গ্রামটি তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষদের জন্য (Dementia Village)।

সেই যে রোদপড়া বিকেলে সুখে-দুঃখের হাজারো গল্পে মেতে উঠল কয়েকজন, তারা কিছুক্ষণ পরেই ভুলে যাবে সমস্ত ঘটনা। সন্ধে নামলে কোনো এক পরিচারক এসে হাত ধরে নিয়ে যাবে নিজের ঘরে। আবার পরদিন থেকে ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাপন শুরু হবে তাদের। বাজারে যাবে, কিছু সামগ্রী কিনে তুলে দেবে পাচকের হাতে। সকাল-দুপুর-রাতে তাদের হাতে পৌঁছে যাবে স্বাস্থ্যকর খাবার। কেউ খেতে পারেন নিজের ঘরে, কেউ-বা রেস্তোরাঁতে বসে। আবার শখ-আহ্লাদ হলে কেনাকাটা করারও সুযোগ রয়েছে তাদের। কিন্তু টাকা পাবেন কোথায়? সেই ব্যবস্থাও আছে এখানে। প্রতি মাসে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় কিছু ‘নকল’ টাকা। সেই দিয়েই সারা মাসের সংসার চলে তাদের। অবশ্য অনেক সময় টাকা দিতে ‘ভুলে’ গেলেও, কিছু মনে করে না দোকানি।

আসলে হগওয়ে একটি পরীক্ষামূলক হাসপাতাল। কিন্তু সেটাই ছড়িয়ে রয়েছে গ্রাম জুড়ে। আর পাঁচজন মানুষের মতো ‘সাধারণ’ করানোর মধ্যে দিয়েই চিকিৎসা চলছে রোগীদের। এই মানুষগুলি যাতে হাসপাতালের চার দেওয়ালের বন্দি হয়ে কখনই নিজেদের বন্দি বলে না মনে করেন। বছর তিরিশ আগে আমস্টারডামের একটি হাসপাতালের চিকিৎসক ভনে ভান আমেরোনগেন, জ্যানেট স্পিয়েরিং প্রমুখ প্রথম নিয়ে আসেন এই পরিকল্পনা। সেই অনুযায়ী ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রামের ব্যবস্থাপনা। কয়েকজন ‘ডিমেনশিয়া’ আক্রান্ত মানুষ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একে-অপরের পাশে দাঁড়িয়ে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গল্পগুজব করে দিন কাটাবেন, এটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। দোকানের কর্মচারী বা বাড়ির প্রশিক্ষিত পরিচারক-পরিচারকরা সেই মতো ‘অভিনয়’ করে যাচ্ছেন। ডাক্তাররা নিয়মিত আসেন চিকিৎসার জন্য।

চার একর জমির উপর এই শহরে রয়েছে ৩২টি বাড়ি। যার প্রত্যেকটিতে থাকেন ছয়-সাতজন বাসিন্দা। বাড়ি নির্বাচন করা হয় রোগীদের ভালোবাসা, পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে। তাদের ঘর সাজানোর পদ্ধতি, প্রিয় খাবার বা গান ইত্যাদি দেখে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে চিকিৎসা করা হয়। ১৫০ জনের মতো রোগীর জন্য বরাদ্দ ২৫০ জন পরিচারক। রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান, সাদামাটা দুয়েকটি রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, পোস্ট অফিস। চিকিৎসার খরচের একটি বড়ো অংশ ব্যয় করে নেদারল্যান্ডসের সরকার। অবশ্য একই সঙ্গে বিতর্ক ধেয়ে এসেছিল আমেরোনগেনের পরিকল্পনা নিয়ে। এই ‘নকল’ গ্রামের ব্যবস্থা আদৌ নৈতিক কিনা, সেই প্রশ্নে বারবার ব্যতিব্যস্ত হতে হয় হগওয়েকে। মানসিক অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে, এও একপ্রকার ‘বোকা’ বানানো নয় কি? কিন্তু হগওয়ে কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। স্মৃতির ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে থাকা কয়েকজন মানুষ যদি উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে, তাহলে অসুবিধা কোথায়? জীবন এখানে শান্ত আর সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাহ্যিক দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই থেকে মুক্ত। এদের জন্য যা সবচেয়ে বেশি দরকারি বলেই মনে করেন তারা।

আরও পড়ুন
এই গ্রামের বাসিন্দা মাত্র একজন!

হগওয়ের পথ ধরেই কানাডা আর ইংল্যান্ডেও গড়ে উঠেছে এরকম গ্রাম। বিতর্ক আর মতবিরোধের মধ্যেও চলছে তাদের পরিকল্পনা। তবে প্রশ্ন জাগাটা খুব স্বাভাবিক যে, এভাবে মানুষের স্বাধীন সত্তাকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেওয়াটাই কি প্রকৃত চিকিৎসা? ব্যবহারিক সমস্ত সুবিধা দিলেও স্বতন্ত্র গ্রামে রেখে দেওয়া কি তাদের একঘরে করে দেওয়া নয়? রোজকার দুনিয়ার আর পাঁচজন মানুষের দৈনন্দিন স্রোতের সঙ্গে মিলে থাকাই হতে পারত উপযুক্ত পথ। 

আরও পড়ুন
মুণ্ড শিকারের গ্রাম! ভারত-মায়ানমার দু’দেশেরই নাগরিক এই গ্রামের বাসিন্দারা

Powered by Froala Editor