করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ আটকে দিশেহারা প্রশাসন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেঙে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। চিকিৎসকরাও যেন এক অসম লড়াইয়ের মুখোমুখি। কারণ, হাত-পা বাঁধা তাঁদেরও। পর্যাপ্ত শয্যা নেই হাসপাতালে। নেই অক্সিজেনের জোগান। সংকটকালীন এই অবস্থাতে ত্রাতা হয়ে এগিয়ে এসেছে দিল্লির একদল তরুণ। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মুমূর্ষু রোগীদের বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁরা।
“ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি আমরা। প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে কোভিড। অক্সিজেনের জন্য হাহাকার চলছে সারা দেশে। এমত অবস্থায় যাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার করা হয় অক্সিজেন রিসোর্স, সে-জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ”, বলছিলেন টাইসিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মোহিত রাজ।
করোনার এই পরিস্থিতিতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাচ্ছে তরুণদের হাতে জন্ম নেওয়া এই সংস্থা। প্রাথমিক লক্ষ্য, কোনোভাবে যেন অপব্যবহার না হয় অক্সিজেনের। কিন্তু কীভাবে? সহজ সমাধান পুনর্ব্যবহার। আর সেই পথেই হাঁটছেন মোহিতরা। ‘অনেকের পরিবার রোগীর জন্য অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করেছিলেন বাড়িতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো বাঁচানো সম্ভব হয়নি তাঁদের। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে, সিলিন্ডারে অব্যবহৃতভাবেই রয়ে গেছে খানিকটা অক্সিজেন। সেগুলোকেই সংগ্রহ করে মুমূর্ষু রোগীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি আমরা। সামান্য এই অবশিষ্টাংশও তো প্রাণ বাঁচাতে পারে কোনো মানুষের”, জানালেন মোহিতবাবু।
আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত মানবতাবাদী নেতা মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান
এই কাজটার মধ্যে যে কী বিপুল পরিমাণ ঝুঁকি রয়েছে, তা আর নতুন করে বলার নয়। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহের জন্য তাঁদের যেতে হচ্ছে করোনাভাইরাস হটস্পটগুলিতে। এমনকি খোদ কোভিড আক্রান্ত বা কোভিডে মৃত ব্যক্তির বাড়ি থেকেই সিলিন্ডার সংগ্রহ করে আনছেন তাঁরা। তারপর তা পৌঁছে যাচ্ছে হাসপাতালে অথবা অন্যান্য রোগীর বাড়িতে। বিনামূল্যেই। পরিবহণের সমস্ত দায়িত্বই নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন দিল্লির এই তরুণরা। তবে এতটুকু ফাঁক নেই সতর্কতায়। পিপিই কিট পরে, সমস্ত বিধি মেনেই এই প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন তাঁরা। খেয়াল রাখা হচ্ছে তাঁদের জন্যও যেন আক্রান্ত না হন অন্য কেউ।
আরও পড়ুন
তাঁদের সুরেই অভিষেক কুমার শানুর, করোনায় ছিন্ন নাদিম-শ্রাবণ জুটি
আরও পড়ুন
করোনাকালে গৃহহীন ইংল্যান্ডের ৭ লক্ষ পরিবার!
তবে এখানেই শেষ নয়। অক্সিজেন সিলিন্ডার ভর্তি করার জন্যেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিচ্ছেন তাঁরা ডিলারের কাছে। অক্সিজেনের অভাব এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ একটি সিলিন্ডারই নিতে পারছেন হোল সেলারের থেকে। তাও তার জন্য দাম পড়ছে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু সকলের কি সামর্থ্য রয়েছে এই চড়া দামে অক্সিজেন কেনার? তাই সেদিক থেকেও সঞ্জীবনীর সরবরাহ সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে টাইসিয়া। বাস্তব পরিস্থিতির কথা জানালেন মোহিতবাবু, “রাত ১১টা থেকে প্রায় লাইনে পড়ে যাচ্ছে ডিলারের কাউন্টারে। পরদিন বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর পাওয়া যাচ্ছে অক্সিজেন। তবে অপেক্ষা করার পরেও যে সকলে অক্সিজেন পাচ্ছেন, তেমনটা নয়।” কোভিড আক্রান্তদের জন্য নিঃস্বার্থভাবেই এই কাজটা করে চলেছেন মোহিতবাবুরা।
আক্রান্তদের পরিবার যাতে যোগাযোগ করতে পারেন তাঁদের সঙ্গে, সে জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে চালু করা হয়েছে বিশেষ হেল্প লাইন নম্বরও। প্রতিনিয়তই সেখানে ভেসে আসছে হাজার হাজার কল। শত শত অনুরোধ। তাই এর মধ্যেও যথেষ্ট হিসেব কষেই পদক্ষেপ নিচ্ছেন মোহিতরা। অক্সিজেন লেভেল ৭০-এর কমে নেমে যাওয়া রোগীদের প্রাধান্য দিচ্ছেন সবথেকে বেশি।
জানা গেল, এখনও পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশের বেশি আক্রান্তের কাছে তাঁরা পৌঁছে দিতে পেরেছেন অক্সিজেন। পাশাপাশি চলছে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়াও। নতুন অক্সিজেন সিলিন্ডারের যোগান অব্যাহত রাখার পূর্ণ প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। লক্ষ্য, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে ৫০০ মানুষের কাছে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া। অন্যদিকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে চলছে ডিজিটাল ক্যাম্পেনিং-ও।
গতবছর ভারতজুড়ে লকডাউন ঘোষণার ঠিক পর থেকেই এই যুদ্ধ শুরু করেছিলেন মোহিতবাবুরা। পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর জন্য বাসের বন্দোবস্ত করা থেকে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁরা। এবারেও চরমতম সংকটের দিনে ত্রাতা হয়ে দাঁড়ালেন তাঁরাই। ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ যে এত সহজেই হেরে যাচ্ছি না আমরা— সেই আশ্বাসই দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম…
Powered by Froala Editor