২৬ জানুয়ারি, ২০২১। ইতিহাস বলছে, ভারতের ৭২তম প্রজাতন্ত্র দিবস। তবে শুধু কি এই একদিক থেকেই মনে রাখা হবে দিনটিকে? প্রজাতন্ত্র দিবস আসার তখনও অনেক দেরি ছিল। ততদিনে দিল্লির বাইরে আন্দোলনে নেমেছিলেন দেশের কৃষকরা। প্রবল ঠান্ডাতেও অবস্থান বিক্ষোভ দুর্বল হয়নি। তাঁদের প্রতিবাদ সরকারের বিরুদ্ধে, সরকারের নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে। আর তার জন্যই অন্যরকম প্রজাতন্ত্র দিবস উপহার দিলেন তাঁরা। পুলিশের মার, প্রশাসনের রক্তচক্ষু— সবকিছু সরিয়ে রাস্তায় নেমে এল ট্রাক্টর। আর তারপর? ব্যারিকেড ভেঙে কৃষকরা ঢুকে গেলেন ঐতিহাসিক লালকেল্লায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যেতেই সেখানে পৌঁছে গেলেন তাঁরা…
এমন পরিস্থিতিতে, লালকেল্লা ঠিক কী ভাবছে? কৃষকদের দখলে চলে যাওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া কী? জড়বস্তুর তো কোনো জীবন নেই, ভাষাও নেই। কিন্তু ইতিহাসের তো আছে! লালকেল্লার বিরাট ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে সেই ইতিহাসই বারবার কথা বলে উঠল। আজকের কৃষক আন্দোলন বলে নয়, নানা সময় নানা আন্দোলন দেখেছে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় দুর্গ। এবং সময়-অসময় অনেকেই এই দুর্গের ওপর নজর রেখেছে। দখল করেছে লালকেল্লা। কিন্তু সেসব তো ক্ষমতার ইতিহাস। শুধুই কি তাই? আসুন একবার ফিরে দেখা যাক…
তখন ঔরঙ্গজেব দিল্লির মসনদে আর নেই। আহমেদনগরে দেহ রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের গদি টালমাটাল। কে আসবেন নতুন বাদশাহ হিসেবে? তিনি কি আগের মতোই শক্তিশালী হবেন? এসব নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ঔরঙ্গজেবের পর এলেন জাহান্দার শাহ, তারপর তাঁকে খুন করে এলেন ফারুকশিয়ার। এবং তারপর ১৭১৯ সালে এলেন মহম্মদ শাহ। আর তাঁর সময়ই প্রথমবার সমস্যার সম্মুখীন হল লালকেল্লা। দিল্লির গদি এখন দুর্বল, অতএব এখনই আক্রমণের সময়। কে করলেন? পারস্যের শাসক নাদির শাহ। দিল্লির বুকে রক্ত ঝরালেন তিনি। এবং তছনছ করে দিলেন মুঘল সৈন্যদের। এই প্রথম লালকেল্লা অন্য কারোর দখলে গেল। রীতিমতো লুঠতরাজ শুরু করলেন নাদির শাহ। এবং এই সময়ই শাহজাহানের প্রিয় ময়ূর সিংহাসনটিও চুরি করলেন তিনি।
এরপর মুঘল সাম্রাজ্যের ভিতটাই নড়ে গেল। ভারতের বাকি অংশ বুঝে গেল, দিল্লির আর জোর নেই। আর এই সুযোগটারই অপেক্ষায় ছিল মারাঠারা। শেষমেশ মুঘলরা একপ্রকার বাধ্য হয়ে মারাঠাদের সঙ্গে চুক্তি করল। সেই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, মারাঠারা লালকেল্লার রক্ষাকর্তা হয়ে গেল। বেশ কিছুকাল ছিলই; কিন্তু এমন সময় হাজির হলেন আহমেদ শাহ আবদালি। শুরু হল পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ। আফগান শক্তির কাছে পরাস্ত হল মারাঠারা। এবং দেখতে দেখতে আবারও লালকেল্লা দখল। আহমেদ শাহ আবদালি দিল্লির মসনদে এসে বসলেন।
আরও পড়ুন
ইতিহাসের বৃহত্তম ট্রাক্টর মিছিল, প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশের চোখ রাজধানীতে
এরপর গোটা আঠেরো শতক জুড়েই চলল দখল-বেদখলের খেলা। মুঘলরা কার্যত হাতের পুতুল তখন। আফগানদের সরিয়ে আবারও লালকেল্লা দখল করল মারাঠারা। তাঁরা কেবলই রক্ষাকর্তা; মসনদে বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম। কিন্তু এরপরেও শান্তি পেল না লালকেল্লা। মারাঠারা যাওয়ার পরই দিল্লি আক্রমণ করলেন শিখরা। বাঘেল সিং ধালিওয়ালের নেতৃত্বে আবারও বেদখল লালকেল্লা। তবে শেষটা করল ব্রিটিশ রাজশক্তি। ততদিনে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন
কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ‘বেলা চাও’-এর পাঞ্জাবি অনুবাদ, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল ভিডিও
এতক্ষণ ধরে লালকেল্লা দখলের যে কাহিনির আভাস পেলেন, তা ছিল ক্ষমতার লড়াই। তবে শেষ করব যে ঘটনাটি দিয়ে, তা কিন্তু ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়; স্বাধীনতার। ১৮৫৭ সাল। ব্রিটিশরা তখন পুরোপুরি ক্ষমতার অলিন্দে। এমন সময় শুরু হল সিপাহী বিদ্রোহ। লালকেল্লায় তখন বৃদ্ধ মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ। তাঁর কোনো ক্ষমতাই প্রায় নেই। কিন্তু সেই বাহাদুর শাহকেই নেতা হিসেবে মানলেন সিপাহীরা। বিদ্রোহ চলাকালীনই দলে দলে সিপাহীরা দখল করে নিলেন লালকেল্লা। এটাও যে রাজশক্তির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা। কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি সেই প্রতিবাদ। শক্তিশালী ইংরেজরা অচিরেই বিশাল বাহিনী নিয়ে ছুটে এলেন লালকেল্লায়। সেই হামলায় অনেকটা ক্ষতি হল স্থাপত্যটির।
আরও পড়ুন
বিক্ষোভে উত্তাল কৃষকরা, ভারতবাসীর স্বাদ ‘আমুল’ পাল্টে দিলেন ত্রিভুবনদাস
অবশ্য এখানেই থেমে থাকবে কেন? আমরা কী করে ভুলব নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু'র সেই আহ্বান- 'দিল্লি চলো'! তাঁরও তো লক্ষ্য ছিল সেই লালকেল্লা। বরাবরের ক্ষমতা, শাসকের প্রতীক হয়ে থেকেছে এই দুর্গটি। নেতাজি বলেছিলেন, তিনি এবং তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনী ব্রিটিশদের পরাজিত করে এই লালকেল্লাতেই উপস্থিত হবেন। তারপর এখানেই ওড়াবেন ভারতের জাতীয় পতাকা। এই দৃশ্য দেখা না গেলেও, নেতাজির সেই কথা তো আজও জীবিত। সেই বহমান ধারাই আজ দেখা গেল আবার। লালকেল্লায় পৌঁছে গেছেন দেশের কৃষকরা। বিতর্ক-তর্ক, বাদানুবাদের মাঝে অন্যরকম প্রজাতন্ত্র দিবস দেখল ভারত। তাঁদের প্রতিবাদ দেশের বিরুদ্ধে নয়; সরকারের নীতির বিরুদ্ধে। এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী, তা কেউ জানে না। কিন্তু এতসবের মধ্যে লালকেল্লা ইতিহাসেরই প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাসক, শাসিত, প্রতিবাদ ও আন্দোলনের ঐতিহাসিক দর্শক হিসেবে…
আরও পড়ুন
প্রতীক হিসেবে উঠে আসছেন ভগৎ সিং -- আন্দোলন নয়, বিপ্লবের প্রস্তুতি কৃষকদের
Powered by Froala Editor