মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র। স্নায়ুকোষ কিংবা নিউরোনের মধ্যে দিয়েই মস্তিষ্কের আদেশ গিয়ে পৌঁছায় নির্দিষ্ট অঙ্গে। আর সেই আদেশ অনুযায়ীই কাজ করে সংশ্লিষ্ট অঙ্গটি। কিন্তু প্রযুক্তির সাহায্যে কোনো মানুষের মস্তিষ্কে মাধ্যমে যদি ভিন্ন কোনো ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গতিবিধি পরিচালনা করা যায়? হ্যাঁ, শুনতে অসম্ভব লাগলেও সত্যি। তবে নিউরোসায়েন্সের (Neuroscience) এই অবাক দুনিয়ায় ক্রমশ ডানা মেলছে ভারতও। আর তার নেপথ্যে রয়েছেন দিল্লির (Delhi) তরুণ প্রযুক্তিবিদ দীপক ক্ষত্রী (Deepak Khatri)।
২০১৬ সাল। দিল্লির নেতাজি সুভাষচন্দ্র ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে তিনি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রথমবার স্নায়ুবিজ্ঞানী ও ‘ব্যাকইয়ার্ড ব্রেন’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগ গেজকে তিনি ডেমোনস্ট্রেশন দিতে দেখেছিলেন এই অদ্ভুত যন্ত্রের, যা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ভিন্ন কোনো ব্যক্তির স্নায়ুতন্ত্রকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ডিআইওয়াই কিট হিসাবে এই যন্ত্র উপলব্ধ বৈশ্বিক বাজারে। অর্থাৎ, শুধু চিকিৎসক বা বৈজ্ঞানিকরাই নন, বরং সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও তা কিনতে পারেন অনলাইনেই।
ছোটো থেকেই ইলেকট্রনিক্স পছন্দের বিষয় ছিল দীপকের। সেই বয়সেই বিভিন্ন খেলনা কিংবা বাড়ির টেলিভিশন সেট খুলে, সেগুলির যন্ত্রাংশের কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করতেন তিনি। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। গ্রেগের বক্তৃতা ও প্রযুক্তি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল দীপককে। এরপরই শুরু হয় নিউরোসায়েন্স এবং নিউরো-প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর গবেষণা। যেখানে সে-সময় গ্রেগের তৈরি ডিআই কিটের দাম ছিল প্রায় হাজার দুয়েক টাকা, সেখানে মাত্র কয়েকশো টাকার মধ্যেই অনুরূপ কিট তৈরি করে নজর কাড়েন দীপক।
এখানেই শেষ নয়। ২০১৭ সালে তিনি তৈরি করে ফেলেন স্বল্পমূল্যের আস্ত একটি বায়ো-অ্যাম্পিফায়ার। যা ইইজি, ইসিজি, ইকেজি, ইএমজি-র মতো জৈব-সংকেতকে অ্যাম্পিফাই করতে সক্ষম। ২০১৯ সালে ‘গুগল সামার অফ কোড’ প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয় তাঁর এই উদ্ভাবনী। পরের বছর, অনলাইনে এক ব্যক্তি তা কিনতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এই সাফল্যের পরই মহামারীর সময় নিউরো-সায়েন্স কিট তৈরির একটি সংস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা করেন দীপক। ২০২০ সালের শেষের দিকে শুরু হয় তাঁর স্টার্টআপ ‘আপসাইড ডাউন ল্যাবস’। পাঁচশো টাকারও কম মূল্যে তাঁর তৈরি নিউরো-কিট এখন উপলব্ধ ভারতের বাজারে। লক্ষ্য, ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণদেরকে নিউরোসায়েন্স এবং রোবটিক্সে আগ্রহী করে তোলা। ২৪ বছর বয়সি তরুণ প্রযুক্তিবিদ দীপকের অভিমত, স্কুলস্তরীয় শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও পর্যন্ত নিউরোসায়েন্স পড়ানো হয় না। কোনো কোনো কলেজে এই বিষয়টি থাকলেও, তা নিয়ে প্রচার হয় না বললেই চলে। ফলে, তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্রাত্যই থেকে যাচ্ছে নিউরোসায়েন্স। অথচ, পরিসংখ্যান বলছে চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রতি ৫ জন রোগীর মধ্যে একজন আক্রান্ত স্নায়বিক রোগে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আগামীদিনে স্নায়ুবিজ্ঞানী ও স্নায়ুপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োজন আছে ভারতের মতো জনবহুল দেশে। তরুণ প্রজন্মকে এই বিষয়ে আকৃষ্ট না করলে, বৈশ্বিক বাজারে নিজের জায়গা হারাবে ভারত।
বর্তমানে ভারত তো বটেই, ভারতের বাইরেও ২২টি দেশে রীতিমতো জনপ্রিয়তা পেয়েছে দীপকের তৈরি ডিওয়াইআই কিট। সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড-সহ একাধিক উন্নত দেশের ছাত্র-ছাত্রীরাও ব্যবহার করছেন ‘আপসাইড ডাউন ল্যাবস’-এর তৈরি সামগ্রী। বিশ্বজুড়ে এখন প্রায় ১২ হাজার মার্কিন ডলারের ব্যবসা তাঁদের। আগামীদিনে স্নায়ুবিজ্ঞানের জগৎকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেবে দীপকের এই উদ্যোগ, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor