গত বৃহস্পতিবার খারিজ হয়ে গেল তৃতীয়বার জামিনের আবেদন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও জেল হেফাজতে থাকতে হবে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সাফুরা জারগারকে। এমনটাই জানাল পাটিয়ালা হাউস আদালত। গত ১০ই এপ্রিল থেকেই তিনি দিল্লির তিহার জেলে বন্দি রয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জড়িত ছিলেন বেআইনি কার্যকলাপ এবং দিল্লির দাঙ্গার সঙ্গে।
গত ফেব্রুয়ারিতেই জ্বলছিল উত্তর-পূর্ব দিল্লি। বিগত কয়েক দশকের জঘন্যতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাক্ষী হয় দিল্লি। শেষ ১৯৮৪-র পর এত বড়ো দাঙ্গার শিকার হয় রাজধানী। মারা গিয়েছিলেন ৫৩ জন। দিল্লি দেখেছিল রাস্তায় প্রকাশ্যে গুলি চলতেও। কিন্তু এই দাঙ্গার সূত্রপাত কোথায়? আরেকটু পিছিয়ে যেতে হবে সময়ের সঙ্গে।
২০১৯ শেষের দিকে। পাশ হয়েছে নাগরিকত্ব আইন। আর তার প্রতিবাদেই প্রথমে অসম এবং তার পর আন্দোলনের আগুনে ছেয়ে যায় দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের একাধিক রাজ্য। আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী। পিছিয়ে ছিলেন না ছাত্র-ছাত্রীরাও। জওহরলাল নেহরু, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল এই আন্দোলনে। এই আন্দোলনের একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সাফুরা জারগার।
২৪শে ফ্রেবরুয়ারি থেকেই দিল্লিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। জ্বলছিল দিল্লির রাস্তাঘাট এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও। জামিয়া মিলিয়াতেও হামলা হয়েছিল ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর। সেই দৃশ্যও সকলেই কম বেশি প্রত্যক্ষ করেছেন সকলেই।
তারও মাস খানেক পর শুরু হয়েছিল লকডাউন। ততদিনে থিতিয়ে এসেছে দাঙ্গার পরিস্থিতি। ১০ এপ্রিল লকডাউনের মধ্যেই গ্রেপ্তার হলেন সাফুরা জারগার। অভিযোগ ছিল দিল্লির দাঙ্গার পিছনে রয়েছে জারগারের উস্কানিমূলক মন্তব্য। তাঁর বিরুদ্ধে আঠেরোটি ধারা মামলা করা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে হিংসা ছড়ানোর পাশাপাশি, অশান্তি, অস্ত্র দখল, হত্যার চেষ্টা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা। গত ১৮ই এপ্রিল জামিনের জন্য আবেদন করার পর এর ওপরেই কার্যকর করা হয় UAPA, সন্ত্রাস আইন। প্রমাণ হিসাবে পুলিশ আদালতে পেশ করেছে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের কিছু চ্যাট এবং বক্তব্য। যেখানে উল্লেখ ছিল ‘চাকা জ্যাম’-এর মতো কথা। তা থেকেই সিদ্ধান্তে আসা হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সহযোগিতা করেছিলেন সফুরা।
যদি এই ঘটনা উস্কানিমূলক হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের মন্তব্যও ত্বরান্বিত করেছিল দাঙ্গার পরিস্থিতিকে, সে কথা ভুলে যাওয়া হচ্ছে কেন, এ-ব্যাপারে প্রশ্নও থেকেই যায়। ভিডিও এবং যথাযত তথ্য প্রমাণ থাকলেও একাধিক অভিযুক্তদের ওপর কোনো রকমই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি দিল্লির রাস্তায় শাহিনবাগের ধর্নামঞ্চের কাছে প্রকাশ্যে বন্দুক চালিয়েছিলেন যিনি, সেই কপিল গুজ্জারকেও জামিন দেওয়া হয়েছিল মাত্র ২৫ হাজার টাকায়। অথচ বন্দি রয়েছেন আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরা। এই দুই ঘটনা কি দ্বিচারিতা নয়?
গত এপ্রিলের শুরুতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই সাফুরা জারগারের চলাচল সীমিত করে দিয়ে ছিলেন চিকিৎসক। তিনি এখন ২১ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা। এছাড়াও ভুগছেন পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিসঅর্ডারে। তার মধ্যেও তাঁকে দিন গুনতে হচ্ছে জেলের মধ্যেই। প্রশ্ন উঠছে কতটা মানবিক এই সিদ্ধান্ত? যখন দেশ গর্ভবতী একটি হাতির মৃত্যুতে উত্তাল; সরকার যেখানে বারবার অন্তঃসত্ত্বাদের মহামারীর পরিস্থিতিতে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করছে বারবার, সেই সময়ে আরেক অন্তঃসত্ত্বাকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে জনবহুল কারাগারের অন্ধকারে। বিচার ব্যবস্থার এই মেরুকরণ নিয়েও সম্প্রতি সরব হতে দেখা যাচ্ছে নানা মহলকে। এই পরিস্থিতির সমাধান কী? উত্তর আছে কিছু? আলোচনা চলুক...
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor