সম্বল বলতে আধ একর জমি। কৃষিকাজ করে যা সামান্য উপার্জন, তাতে ছ’জনের সংসার চালানোই দায়। খাবার বলতে নুন আর সেদ্ধ ভাত। ফলন ভালো হলে দৈবাৎ পাতে জুটত শাক-সবজি। এমন চরম এক আর্থিক অনটনের সঙ্গেই তাঁর লড়াই শুরু হয়েছিল জন্মলগ্ন থেকে। প্রয়োজনীয় ক্রীড়াসামগ্রী তো দূরের কথা, জুটত না পুষ্টিকর খাবারটুকুও। চঞ্চলা কুমারী। ঝাড়খণ্ডের এই চতুর্দশীই আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছেন ভারতের হয়ে।
কুস্তির কথা উঠলেই একবাক্যে উচ্চারিত হয় হরিয়ানা, দিল্লি, পাঞ্জাব কিংবা মহারাষ্ট্রের নাম। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কুস্তির ময়দানে প্রায় ৯৯ শতাংশ প্রতিদ্বন্দ্বীই মূলত আসেন এই চার রাজ্য থেকেই। বহু বছর পর এবার সেই চেনা ছক ভেঙেই ক্যাডেট কুস্তীর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ লড়তে চলেছেন ঝাড়খণ্ডের ১৪ বছর বয়সী কিশোরী। ২০০০ সালে নতুন রাজ্য তৈরির পর থেকে এই প্রথম কোনো কুস্তিগির উঠে এল ঝাড়খণ্ড থেকে।
রাঁচি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের হাটওয়াল গ্রামেই বড়ো হয়ে ওঠা চঞ্চলার। কিন্তু পদে পদে কাঁটার মতো বিছিয়ে ছিল প্রতিবন্ধকতা। একদিকে যেমন আর্থিক অনটন, অন্যদিকে সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতা। তাঁরা যে আদিবাসী জনগোষ্ঠী ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষ। তাই খানিক নিচু নজরেই তাঁদের দেখত ‘সভ্য’ সমাজ।
২০০৯ সালে ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকার গ্রামীণ অঞ্চল থেকে তরুণ ক্রীড়াপ্রতিভা তুলে আনতে বিশেষ একটি উদ্যোগ নেয়। গঠিত হয় ঝাড়খণ্ড স্টেট স্পোর্টস প্রোমোশন সোসাইটি। অন্যান্য অঞ্চলের মতো হাটওয়ালেও আয়োজিত হয়েছিল সেই ক্যাম্প। রাজ্য স্তরের ক্রীড়াক্ষেত্রে সুযোগ পেলে অন্তত দু’বেলা ভাত জুটবে সন্তানের— এই কথা ভেবেই চঞ্চলাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর মা। সেটা ২০১৬ সালের কথা। চঞ্চলার বয়স তখন ১১ বছর। তখনও পর্যন্ত কুস্তির সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো ধারণাই নেই তাঁর। কিন্তু সেই ঘটনাই যেন ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছিল চঞ্চলার।
আরও পড়ুন
স্বপ্ন থামতে দেননি শ্রমিক দিদা, দারিদ্রকে হারিয়ে অলিম্পিকে নাতনি রেবতী
মাত্র ছ’মাসের প্রশিক্ষণ আর কঠোর অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই একেবারে নতুন এই খেলাকে আয়ত্তে এনেছিলেন চঞ্চলা। তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিল নির্বাচক কমিটিও। সুযোগ আসে রাজ্য স্তরে খেলবার। পেশাদার কুস্তির রিং-এ লড়াই শুরু সেই প্রথম। বছর খানেকের মধ্যেই ২০১৭-১৮ সালে ভারতের স্কুল গেমস ফেডারেশনের প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদক জিতে নেন চঞ্চলা। ২০১৮ ও ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ এর জাতীয় স্তরে সোনা। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ঝাড়খণ্ডের খুদে তারকাকে। একের পর এক সাফল্য আসতে থাকে তাঁর হাত ধরে।
আরও পড়ুন
দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে টোকিও অলিম্পিক, জরুরি অবস্থা জারি জাপানে
গত বছরের শেষের দিকে কোটাতে অনুষ্ঠিত জাতীয় টুর্নামেন্টে ব্রোঞ্জ পদক জেতে চঞ্চলা। তার দৌলতেই ভারতের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ আসে তাঁর কাছে। লখনৌতে কুস্তি তারকা সাক্ষী মালিক এবং গীতা ফোগটের সঙ্গে প্রশিক্ষণও নেন তিনি। ২০২১ সালের মার্চে সেই বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবিরের ফর্মের নিরিখেই ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন চঞ্চলা।
আরও পড়ুন
পদকজয়ের স্বপ্ন নিয়ে অলিম্পিকে তামিলনাড়ুর পুলিশ কনস্টেবল
আগামী ১৯ জুলাই থেকে শুরু হতে চলেছে হাঙ্গেরিতে আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। চলবে ২৫ জুলাই পর্যন্ত। বর্তমানে দিল্লিতেই চূড়ান্ত অনুশীলন চলছে চঞ্চলার। চলতি সপ্তাহেই তিনি উড়ান দেবেন হাঙ্গেরির উদ্দেশ্যে। প্রতিযোগিতায় ফলাফল কী হবে, তা বলা সম্ভব নয় আগে থেকে। তবে নিজের সেরাটা উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ভারতের তরুণ তারকা। আর তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ওপর ভর করেই স্বপ্ন দেখছে গোটা দেশ…
Powered by Froala Editor