১১ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো কথাই বলতে পারতেন না তিনি। আচরণও আর পাঁচটা স্বাভাবিক কিশোর-কিশোরীর মতো ছিল না। লেখা-পড়া তো দূরের কথা অক্ষরমালা কিংবা শব্দ চিনতেও সমস্যা হত তাঁর। নেপথ্যে অটিজম (Autism)। সেসময় থেরাপিস্টও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কোনোভাবেই শারীরিক অবস্থার উন্নতি হবে না তাঁর। এমনকি আজীবন তাঁকে কাটাতে হবে অন্যের সাহায্যেই। তবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে তিনি তৈরি করলেন এক নতুন নজির।
জেসন আরডে (Jason Arday)। কৈশোরের শেষলগ্নে এসে যাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল পড়াশোনায়, এখন তিনিই শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন শত শত তরুণ-তরুণীর মধ্যে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যাপক হিসাবে নির্বাচিত হয়ে এক নতুন ইতিহাস লিখেছেন ৩৭ বছর বয়সি এই গবেষক।
তবে এই যাত্রাপথ খুব একটা সহজ ছিল না মোটেই। ১২ বছর বয়স থেকে ধীরে ধীরে অক্ষর চিনতে শেখেন আরডে। তারও পরে শব্দপরিচয় কিংবা বাক্যগঠনের ক্ষমতা আয়ত্ত করেন তিনি। লন্ডনের ক্ল্যাফাম অঞ্চলের এক দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা, কাজেই আর্থিক সক্ষমতাও ছিল না সেভাবে। তাই বিশেষ স্কুলে ভর্তি হওয়া হয়নি তার। বরং, সাধারণের সঙ্গেই লড়াই করে নিজের জায়গা পাকা করে নিতে হয়েছে। অন্যদের থেকে বয়সে বড়ো হওয়ায়, কখনও কখনও তীর্যক শব্দবাণের শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল দেশের নিচুর তলার মানুষদের অবস্থা। কেন হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন? কেনই বা যুদ্ধ চলছে গোটা বিশ্বজুড়ে? এসব প্রশ্নই বার বার ফিরে ফিরে আসত তাঁর কাছে। স্কুল পাশ করার পর তাই সমাজবিজ্ঞানকেই বিষয় হিসাবে বেছে নেন তিনি। সারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
সে-সময় এক পরিচিতের সৌজন্যে চাকরিও জুটে গিয়েছিল লন্ডনের এক স্কুলে। ফিজিক্যাল এডুকেশনের প্রশিক্ষকের চাকরি। মাইনে মন্দ নয়। তাতে দিব্যি হেসে-খেলে পেট চলে যায় গোটা পরিবারের। তবে সেখানেই থেমে থাকেননি আরডে। বরং, শুরু করেন বৃহত্তর প্রস্তুতির। সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক হওয়ার প্রস্তুতি। কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে আরডে জানান, ২০১৫ সালে নিজের ঘরের দেওয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, একদিন অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজের অধ্যাপক হবেন তিনি। তাঁর কথায়, এই গ্রাফিতিই তাঁকে শক্তি যুগিয়েছে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।
সে-বছর এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি আবেদন করেছিলেন পিএইচডি করার জন্য। তবে প্রত্যাখ্যাত হন দুটি জায়গা থেকেই। শেষ অবধি লিভারপুল জন মুরস বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়। গবেষণা। ২০১৮ সালে জাতিগত বৈষম্য এবং শিক্ষাব্যবস্থায় বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিবৈষম্যের প্রভাব নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত করেন আরডে। যা সাড়া ফেলে দেয় যুক্তরাজ্যে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল সে-দেশের একটি প্রথম সারির বিজ্ঞানপত্রিকায়।
আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পিএইচডি শেষ করার পরই, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে পড়ানো শুরু করেন আরডে। তবে স্বপ্ন ছাড়েননি। কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ডেও অধ্যাপকের পদের জন্য আবেদন করেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে সেখানে পড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করলেন আরডে। হয়ে উঠলেন সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যাপক। আরডের এই লড়াই অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীকে, অটিজমকে হারিয়ে মূলস্রোতে ফেরার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে যারা…
Powered by Froala Editor