বয়স তখন মাত্র ৭ মাস। জ্ঞান হওয়ার আগেই বাবাকে হারান তিনি। তার বছর খানেকের মধ্যেই আরও এক ধাক্কা। মারা গেলেন মা-ও। লড়াই শুরু সেই থেকেই। পদে পদেই ছিল প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল। তবে কোনো কিছুই থামাতে পারেনি তাঁকে। রেবতী বিরামানি। সেদিনের সেই অনাথ কিশোরীই আজ ভারতের প্রতিনিধি হয়ে হাজির অলিম্পিকের মঞ্চে।
গত রবিবার ৪ জুলাই পাঞ্জাবের নেতাজি সুভাষ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে ৪০০ মিটারের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করলেন এই তামিল তরুণী। আর ৫৩.৫৫ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড়ের ব্যক্তিগত রেকর্ড তৈরি মধ্যে দিয়ে তিনি হাতে পেলেন অলিম্পিকের টিকিট। ২৪ বছর বয়সী এই তামিল তরুণী আসন্ন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন ৪X৪০০ মিটার রিলে রেসে।
বাবা-মা মারা যাওয়ার পর রেবতী ও তাঁর বোন মানুষ হয়েছেন তাঁর দিদার কাছে। দারিদ্রের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ চলত সেখানেও। দৈনিক বেতনের সামান্য শ্রমিকের কাজ করতেন তাঁর দিদা আরাম্মল। তা দিয়েই তিনজনের পেট চালানো। সেইসঙ্গে নাতনিদের পড়াশোনার খরচ। পরিস্থিতি সামাল দিতে কখনও বাড়তি সময়ে করেছেন পরিচারিকার কাজও। তবে এই আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তাঁর কাছে চিরকাল প্রাধান্য পেয়ে এসেছে নাতনিদের স্বপ্ন। হ্যাঁ, একথা ঠিকই, সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু দুই নাতনিকেই চিরকাল তিনি উৎসাহ যুগিয়েছেন ক্রীড়াক্ষেত্রে। আর আজ দু’জনেই পৃথক পৃথকভাবে সফল তাঁদের কেরিয়ারে। রেবতীর বোন আজ একজন সফল ফুটবলার।
কিন্তু দিদাকেও যে চিরকাল পাশে পেয়েছেন রেবতী তেমনটা নয়। তখন সবেমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণী। তামিলনাড়ুর মাদুরাইতে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। হাহাকার একটু খাবারের জন্য। নাতনিদের প্রাণ বাঁচাতে রেবতী ও তাঁর বোনকে শহরের এক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে এসেছিলেন আরাম্মল। সেখানেই বড়ো হয়ে ওঠা দু’জনের। মাসে মাত্র একবার দেখা করতে আসতেন দিদা। অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্নের পিছনে দৌড় শুরু হয় সেই স্কুল থেকেই। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় জোনাল পর্যায়ের একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেন রেবতী। প্রতিযোগীদের মধ্যে একমাত্র তিনি ছাড়া সকলেই ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অ্যাথলিট। অন্যদিকে রেবতীর পায়ে সেদিন ছিল না বুট জুতোও। তবু খালি পায়ে দৌড়েই সেদিন প্রথম হয়েছিলেন। আর তাঁর সেই নজরকাড়া পারফর্মেন্সই দৃষ্টি আকর্ষণ করেন রাজ্যস্তরের অ্যাথলেটিক্স কোচ পি কান্নানের। বদলে যায় জীবন।
আরও পড়ুন
দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে টোকিও অলিম্পিক, জরুরি অবস্থা জারি জাপানে
পরবর্তীতে তাঁর তত্ত্বাবধানে শুরু হয় দৌড়ের ট্রেনিং। মাদুরাইতে সাইয়ের সেন্টারেও রেবতীকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ট্রেনিং ছেড়ে দেন রেবতী। যাতায়াতের দৈনিক খরচ যে ৪০ টাকা! ওই টাকায় দু’বেলা ভাত জুটে যাবে তিন সদস্যের। সেখানে দাঁড়িয়ে খেলার ট্রেনিং যে বাতুলতা। পাশাপাশি পাড়া-প্রতিবেশীর তীর্যক মন্তব্য তো ছিলই। মহিলা হয়েও রেসে মাঠে দৌড়নোকে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষেরা মেনে নেননি কেউ-ই। তবে হাল ছাড়েননি কোচ কান্নান। স্থানীয় স্টেডিয়ামেই তাঁকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন দীর্ঘদিন। অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর দিদা আরাম্মলও।
আরও পড়ুন
পদকজয়ের স্বপ্ন নিয়ে অলিম্পিকে তামিলনাড়ুর পুলিশ কনস্টেবল
বছর তিনেক আগে জাতীয়স্তরে সাফল্য আসার পর খানিকটা আর্থিক সমর্থন পান রেবতী। জোটে রেলের চাকরি। বর্তমানে মাদুরাই ডিভিশনে টিকিট চেকারের কাজ করেন তিনি। অন্যদিকে তাঁর বোনও খেলার দৌলতেই জায়গা করে নিয়েছেন তামিল পুলিশ বিভাগে। ফিনিস্কের মতো এই রূপকথার উত্থান। আর তার সমস্ত কৃতিত্বই কোচ এবং দিদাকে দিতে চান তরুণ তামিল অ্যাথলিট। বর্তমানে গোটা দেশের দায়িত্বই যেন রয়েছে তাঁর কাঁধে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও আলোচনার আড়ালেই রয়ে গেছেন চিরকাল প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করে আসা প্রতিভাশালী তরুণীটি…
আরও পড়ুন
পাননি যোগ্য স্বীকৃতিও, নিঃশব্দেই প্রয়াত দু'বারের অলিম্পিকজয়ী কেশব দত্ত
Powered by Froala Editor