“সো, দিস ইজ হোয়াট দ্য মাল্টিভার্স লুকস লাইক!”
অস্কারের মঞ্চে পুরস্কার নিতে উঠে অস্ফুটে বলে উঠলেন অভিনেতা। আবেগে বুজে আসছে তাঁর গলা।
ব্র্যান্ডন ফ্রেজার (Brendan Fraser)। ‘দ্য হোয়েল’ ছবির মূল চরিত্র চার্লির ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্যই সেরা অভিনেতার হিসাবে অস্কার (Oscar Award) পেলেন আমেরিকান-কানাডিয়ান এই অভিনেতা। তবে প্রথমবার অস্কারের জন্য মনোনীত হয়ে পুরস্কার জয় বলে নয়, বরং এই জয় আসলে তাঁর প্রত্যাবর্তনের প্রতীক। আসলে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও আচমকা সিংহাসন হারিয়ে ফেলা এক রাজপুত্র ফ্রেজার। স্পটলাইট থেকে হঠাৎ সরে দাঁড়ানোর পর ফের সিংহাসন-লাভের লড়াই শূন্য থেকে শুরু করার চেয়েও বোধ হয় কঠিন।
ব্র্যান্ডন ফ্রেজারের অস্কার-জার্নি অনেকটা এমনই। এই গল্পের শুরু ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালে ‘ডগফাইট’ ছবির সৌজন্যেই চলচ্চিত্রের জগতে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। তারপর মার্কিন ছবি ‘স্কুল টাইস’। এক ঝাঁক তরুণ তারকা উঠে এসেছিল এই ছবির হাত ধরেই। ক্রিস ওডোনেল, ম্যাট ডেমন, বেন অ্যাফ্লেকের মতো সেই তালিকায় ছিলেন ব্র্যান্ডনও। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একের পর এক মার্কিন ছবি, টেলিভিশন শো-তে বাজিমাত করেছেন তিনি। ‘জর্জ অফ দ্য জঙ্গল’, ‘মমি’ ফ্র্যাঞ্চাইজি কিংবা ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দি আর্থ’— নব্বই-এর দশক, এমনকি এই শতাব্দীর প্রথম দশকের গোড়াতেও হলিউড কাঁপানো অ্যাকশন হিরোদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্র্যান্ডন। তবে প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ভেঙে পড়তে শুরু করে ধীরে ধীরে এই গড়ে তোলা স্বপ্নপুরী।
বলতে গেলে নিজেকে স্পটলাইট থেকেই নিজেই আড়ালে সরিয়ে ফেলেছিলেন ব্র্যান্ডন। মধ্যবর্তী এই সময়ে একদিকে যেমন তাঁর কোনো চলচ্চিত্র চূড়ান্ত বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি, তেমনই কোনো উল্লেখযোগ্য পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও পাননি তিনি। বিভিন্ন পার্টিতেও তাঁর অনুপস্থিতি রীতিমতো নজর কেড়েছিল দর্শকমহল এবং চলচ্চিত্র সমালোচকদের। সেইসঙ্গে একের পর এক বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া। ব্যাপার কী?
এক যুগ পরে প্রকাশ্যে এসেছিল আসল ঘটনা। ২০১৮ সালে মার্কিন পত্রিকা ‘জিকিউ’-তে এক সাক্ষাৎকারে ব্র্যান্ডন জানিয়েছিলেন তাঁর অসহায়তার কথা। প্রথমত, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গ্রিফিন অটিজমের শিকার। ফলে, চিকিৎসার চালাতে হাজার হাজার ডলারের খরচ বহন করতে হয়েছে তাঁকে। ২০০৩ সালে যৌন হেনস্থার শিকার হন খোদ অভিনেতা। নেপথ্যে ‘হলিউড ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন’-এর আটবারের প্রেসিডেন্ট ফিলিপ বার্ক। এমনকি ব্র্যান্ডন এও অভিযোগ তোলেন, ‘গোল্ডেন গ্লোব’ পুরস্কার থেকে তাঁকে ব্ল্যাকলিস্ট করেছেন বার্ক। এসবের মধ্যেই ২০০৭ সালে স্ত্রী-এর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁর। সেখানেও প্রতি মাসে হাজার পঞ্চাশেক ডলার অ্যালিমনি দিতে হত তাঁকে। সবমিলিয়ে যেন কোণঠাসা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
হলিউডের একসময়ের খ্যাতনামা অ্যাকশন হিরোকে শয্যাশায়ী করে তুলেছিল ডিপ্রেশন। মনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বিগড়েছে শরীরও। একের পর এক অস্ত্রোপচারের মধ্যে দিতে যেতে হয়েছে তাঁকে। সবমিলিয়ে যেন নরকের মধ্যে দিয়েই এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন তিনি।
২০২০ সালে ফের চলচ্চিত্র জগতে প্রত্যাবর্তন করেন ব্র্যান্ডন। স্টিভেন সোডারবার্গের ছবি ‘নো সাডেন মুভ’-এ মূল চরিত্রের অভিনয়ের সুযোগ আসে তাঁর কাছে। তাঁর কথায়, এটাই তাঁর টার্নিং পয়েন্ট। ২০২১ সালে এই ছবির মুক্তির পরেই ‘দ্য হোয়েল’ ছবির জন্য নির্বাচিত হন তিনি। আত্মহত্যাপ্রবণ, সমকামী, হতাশাপীড়িত, স্থূলতার শিকার হওয়া এক অধ্যাপক চার্লির চরিত্রে অভিনয় করতে হবে তাঁকে।
এই চরিত্রের জন্যই নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বদলে ফেলেছিলেন ব্র্যান্ডন। একসময়ের সিক্স-প্যাক অ্যাবস চেহারার ব্র্যান্ডনের ওজন দাঁড়ায় ৬০০ পাউন্ডে। তবে এই পরিশ্রম বৃথা যায়নি। গত সেপ্টেম্বরে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবির প্রিমিয়ারের পরই তা সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা চলচ্চিত্রমহলে। ব্র্যান্ডনের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছিলেন উপস্থিত দর্শকরা। তারপর একের পর এক আন্তর্জাতিক খেতাব-জয়। সবমিলিয়ে এই চরিত্রটির জন্য সেরা অভিনেতা হিসাবে ২০টিরও বেশি পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এমনকি বার্ককে হলিউড প্রেস অ্যাসোসিয়েশন থেকে অপসারণের পর, পেয়েছেন ‘গোল্ডেন গ্লোব’ অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়নও। যদিও এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে দেন তিনি। এবার অস্কার জিতেই ষোলো কলা পূর্ণ করলেন ব্র্যান্ডন। সবমিলিয়ে এ এক রূপকথার প্রত্যাবর্তনই বটে…
Powered by Froala Editor