পৃথিবীর বুকের মধ্যে আকরিক অবস্থায় লুকিয়ে রয়েছে লোহা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ-সহ অজস্র ধাতু। আজ থেকে সহস্রাধিক বছর আগেই সে-সম্পর্কে জানতে পেয়েছিল মানুষ। এমনকি ধাতব খনিজ নিষ্কাশন এবং তার ব্যবহারই বদলে দেয় মানব সভ্যতার গতি। পরবর্তীতে পেট্রোলিয়াম কিংবা কয়লার মতো জ্বালানিই মানুষের হাতে আসে খননকার্যের সৌজন্যেই। কিন্তু শুধুই কি স্থলভাগে নিহিত রয়েছে এইসব প্রাকৃতিক সম্পদ? গত শতাব্দী থেকেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিল মানুষ।
না, শুধু স্থলভাগ নয়, বরং সমুদ্রের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বৃহত্তর খনিজের ভাণ্ডার। এতদিন পর্যন্ত বহু দেশই সমুদ্রে অবস্থিত খনি থেকে উত্তোলন করেছে খনিজ তেল কিংবা প্রাকৃতিক গ্যাস। তবে তার পরিধি ছিল সীমিত। এবার গণহারে সেই খনিজ নিষ্কাশনের সম্মতি দিতে চলেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের শাখা সংস্থা ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথোরিটি’ (The International Seabed Authority) বা ‘আন্তর্জাতিক সমুদ্রতট কর্তৃপক্ষ’।
‘ডিপ সি মাইনিং’ (Deep Sea Mining)। সাম্প্রতিক সময়ে অল্পবিস্তর সকলেই পরিচিত হয়েছেন এই কথাটির সঙ্গে। বাংলায় যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘গভীর সমুদ্র খনন’। সমুদ্রতট থেকে বহু দূরে অবস্থিত, গভীর মহাসাগরের বুক থেকে খনিজ উত্তোলনের পদ্ধতিকেই মূলত ‘ডিপ সি মাইনিং’ বলে অভিহিত করে থাকেন গবেষকরা। অর্থাৎ, সাধারণভাবে সমুদ্র থেকে উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্যাস বা খনিজ তেলের খননকে এই বিভাগে রাখতে চান না তাঁরা। বরং, ‘ডিপ সি মাইনিং’-এর ক্ষেত্রে প্রধানত উত্তোলিত হয় বিরল মৃত্তিকা মৌল, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ভারী ধাতু। পলিমেটানিক নুডলস নামে গোলাকার একধরনের সামুদ্রিক শিলার আকারে পাওয়া যায় এইধরনের খনিজ পদার্থ। উল্লেখ্য, এই খনিজগুলি উত্তোলনের জন্য সমুদ্রতলে ৪-৬ কিলোমিটার পর্যন্ত খননের প্রয়োজন হয়।
এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথোরিটি’-র অন্তর্গত ১৬৭টি দেশ নিজেদের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনেই খনন করার অনুমতি পেত। এবার বিশেষ বিশেষ দেশ এবং সংস্থাকে আন্তর্জাতিক সমুদ্রেও খননকার্যের অনুমতি দিতে চলেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এখনও পর্যন্ত কোনো গভীর সমুদ্রে খননের সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট বিধি বা নিয়মাবলী নেই। ফলে, কোন দেশ বা সংস্থাগুলি আগামীতে সমুদ্রখননের সুযোগ পাবে, তা নির্ধারণ করাই কঠিন হয়ে উঠবে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জন্ম নিতে পারে আন্তর্জাতিক সংঘাত।
এসবের বাইরেও গভীর সমুদ্রে খনন নিয়ে চিন্তিত গবেষকরা। আসলে যে-কোনো খননকার্যের ক্ষেত্রেই খনিজ আকরিক ছাড়াও নিষ্কাশিত হয় একাধিক বিষাক্ত ও ক্ষতিকর পদার্থ। সমুদ্রের খননের ক্ষেত্রেও রয়েছে সেই সম্ভাবনা। মূলত, ধাতব আকরিক উত্তোলনের সময় ব্যাপক মাত্রায় ভারী ধাতুর কণা ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রে— সে-বিষয়ে ইতিমধ্যেই প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। ফলে, সমুদ্র দূষণের প্রেক্ষিত এড়িয়ে যাওয়া যায় না কোনোভাবেই। স্থলজ খননের থেকে এই দূষণ আরও দ্রুত গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে জলবাহিত হয়ে। বিশেষ করে সামুদ্রিক প্রাণীরাই শিকার হবে এই দূষণের। তাছাড়াও সামুদ্রিক খননে উৎপন্ন ধারাবাহিক শব্দের কারণেও প্রভাবিত হবে তিমি, শীল, ডলফিনের মতো প্রাণীরা। এমনকি পাকাপাকিভাবে নেভিগেশন ক্ষমতাও হারাতে পারে তারা।
গভীর সমুদ্র খনন গণহারে বাস্তবায়িত হলে সবুজ শক্তি বা ব্যাটারি প্রযুক্তির দিকে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে মানব সভ্যতা— তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু মানুষের সেই অগ্রগতির জন্য কতটা মাশুল গুনতে হবে প্রকৃতি এবং পৃথিবীকে? আদৌ কি সভ্যতার জন্য সার্বিকভাবে কল্যাণকর হবে মানুষের এই পদক্ষেপ? সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা সকলের কাছেই।
Powered by Froala Editor