“পাখি সব করে রব”—এই কথা বলার দিন কি শেষের পথে? সাম্প্রতিক সমীক্ষা কিন্তু ইঙ্গিত করছে সেদিকেই। একসময়ে মানুষের ভোর শুরু হত পাখিদের কলতানে। এখন বড়ো শহরগুলিতে তো বটেই, শহরতলিতেও ক্রমশ দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে পাখিরা। চড়াই, শালিক-সহ অনেক পাখির দেখা মেলা হয়ে উঠছে কঠিন। শুধু বাংলায় নয়, সারাদেশেই এক অবস্থা। গবেষকদের অনুমান, এইভাবে চললে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশের জীববৈচিত্র্য।
বিশ্বজুড়ে প্রকৃতির ভারসাম্য যেভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, তার প্রভাব পড়েছে পাখিদের জীবনযাত্রার উপরেও। নির্বিচারে গাছ কাটায় বাসস্থান কমছে পাখিদের। নতুন প্রজন্মের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো। এর সঙ্গে বিভিন্ন পক্ষীভুক জীবজন্তুদের শিকার হতে হচ্ছে ক্রমাগত। ফলে এই মুহূর্তে ভারতে বহু পাখিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। অন্তত, তাই বলছে পরিসংখ্যান। গত তিরিশ বছরে ৬০ শতাংশ পাখিদের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। তার মধ্যে গত আট বছরেই কমেছে ৪০ শতাংশ।
২০২৩-এর ২৫ আগস্ট ‘স্টেট অফ ইন্ডিয়া’জ বার্ড’-এর (State of India's Bird) একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। সংস্থাটি মূলত কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-সহ মোট ১৩টি সংস্থার মিলিত প্রয়াসে গঠিত। প্রায় ৩ কোটি পাখির সার্বিক অবস্থা ও বিন্যাস নিয়ে পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষা চালানো হয়। ২০২০-তেও তারা পরীক্ষা করেছিল। সেই সমীক্ষায় ১০১টি প্রজাতির পাখিকে অবিলম্বে সংরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছিল। নিজেরাও চেষ্টা করেছিল সম্মিলিতভাবে একটা ব্যবস্থা করতে।
এ বছরের সংখ্যা আরও চিন্তার। মোট ৯৪২টি প্রজাতির পাখিকে সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করেছিল। তার মধ্যে ১৭৮টি প্রজাতিকে জরুরি ভিত্তিতে সংরক্ষণের জন্য চিহ্নিত করেছে তারা। ১৪টি প্রজাতিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ কনসারভেশন নেচার’-এর (International Union of Conservation Nature) লাল তালিকায় রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মধ্যে আছে নীলকণ্ঠ ও মাছরাঙাও। শিকারি পাখি, হাঁস বা সমুদ্র উপকূলের পরিযায়ী পাখিরাই সবচেয়ে বেশি বিপদের সম্মুখীন। কমেছে মনুষ্যবসতি ও নদীর ধারে বাসা বাঁধা পাখিদের সংখ্যাও।
আরও পড়ুন
নিজ হাতে পাখিদের খাসা বাসা তৈরির নায়ক হিন্দোল আহমেদ
ঠিক কী কারণে এই পরিস্থিতি? মূলত আটটি কারণকে চিহ্নিত করছে তারা। ক্রমপরিবর্তমান প্রকৃতির সঙ্গে অধিকাংশ পাখিই অভিযোজিত হতে পারছে না। দূষণের মতো সমস্যাও বিপদের একটি বড়ো কারণ। নগরায়নের ফলে কমছে বনাঞ্চল, বাসাহীন হচ্ছে পাখিরা। মৃত্যু ঘটছে শিকারিদের হাতে। সদ্যোজাতদের জন্য মিলছে না যথাযথ পরিবেশ। বিদ্যুৎ পরিবহণের জন্য সুউচ্চ টাওয়ারে ধাক্কা খেয়ে কিংবা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে পাখিরা। সমীক্ষা অনুযায়ী, ৬০টি প্রজাতির পাখিরা এই ধরনের দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছে। এদিকে কীট-পতঙ্গ কমে যাওয়ায় দেখা দিচ্ছে খাদ্যের অভাব। ফলে সমস্ত জীববৈচিত্র্যের অবস্থা নিয়েই উঠে যাচ্ছে প্রশ্ন।
আরও পড়ুন
পাখির ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতে হবে চিড়িয়াখানায়! আশ্চর্য চাকরির বিজ্ঞপ্তি ইংল্যান্ডে
ইতোমধ্যেই অবলুপ্তির মুখে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড’ গোত্রের পাখি। আন্দামানের সর্প ঈগল, নীলগিরি পাহাড়ের লাফিংথ্রাস পাখি, গ্রেট গ্রে শ্রাইক, শকুন ইত্যাদি প্রজাতির পাখিদের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। তবে, আশঙ্কার মধ্যেও বেশ কিছু প্রজাতির পাখির সংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে বেড়েছে। কোকিল ও পায়রা যার মধ্যে অন্যতম। গবেষকদের ধারণা, জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে থাকা সত্ত্বেও এরা নিজেদের বদলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে সংখ্যা বেড়েছে ময়ূরেরও।
কিছুটা সেই ভরসাতেই রয়েছেন গবেষকরা। যাতে পাখিরাও মানিয়ে নিতে পারে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে। যদিও তাদের জন্য বিকল্প বাসস্থান খুঁজে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। বনাঞ্চল সংরক্ষণ করতে পারলে বাড়বে পাখিদের সংখ্যা। ২০২০-তে ভারত সরকার ১০ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল। যাতে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা যায়। তবে একদিকে সরকারি প্রকল্প, অন্যদিকে দ্রুতগতির নগরায়নের দ্বন্দ্বে আদৌ পাখিদের অবস্থা কি দাঁড়াবে, সেটা নিয়ে থেকে যাচ্ছে চিন্তা। আজ পাখিদের দিয়ে শুরু হয়েছে, কাল অন্য প্রাণীরাও পড়তে পারে বিপদে। হয়তো একদিন পৃথিবীতে রয়ে যাবে শুধু মানুষ! সেই ভবিষ্যতই কাম্য?
Powered by Froala Editor