ব্রিটিশ ভারতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল মানভূম অঞ্চলের বাংলা ভাষা আন্দোলন। স্বাধীনতার পর সেই আন্দোলন আরও প্রবল হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার সঙ্গী হয়েই একসময় পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে যোগ দিয়েছিল পুরুলিয়া জেলাটি। আবার ১৯৯০-এর দশকে ঝাড়খণ্ড গঠনের দাবি উঠলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুরুলিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার দাবিও উঠেছিল। সেই মুহূর্তে ভাষার চেয়েও বড়ো হয়ে উঠেছিল জাতিসত্তা।
বাংলার সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর থেকেই বিভিন্ন মহলে দাবি উঠতে শুরু করেছে, উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে। আবার এই দাবিকে নেহাৎ বিচ্ছিন্নতাবাদী প্ররোচনা হিসাবে দেখছেন অনেকে। এই দাবিকে ইতিহাসের তৃতীয় বঙ্গভঙ্গ বলেও উল্লেখ করছেন অনেকে। তবে পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে আলাদা রাজ্যের দাবি কিন্তু এই নতুন নয়। এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতের গোর্খাল্যান্ড গঠনের দাবি যেমন উঠে আসে, তেমনই ইতিহাসের সরণি ধরে আরও একটু পিছিয়ে গেলে উঠে আসে কামতাপুর আন্দোলনের কথাও। তবে জটিলতা কি শুধুই উত্তরবঙ্গে? পুরুলিয়া এবং জঙ্গলমহলকে ঘিরেও তো কম রাজনৈতিক তরজা হয়নি পশ্চিমবঙ্গে। এমনকি স্বাধীনতার পর রাজ্যের মানচিত্র বদলের ঘটনাও নজিরবিহীন নয়।
এইসমস্ত দাবির মধ্যে সবচেয়ে জটিল অবশ্যই গোর্খাল্যান্ড সমস্যা। গোর্খা এবং নেপালি জনজাতির মানুষদের পৃথক রাজ্যের দাবি সংবিধান বিরোধী নয়। বরং জাতিগত বা ভাষাগত বৈচিত্রের বিচারে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তার প্রায় কোনো মিল নেই। তবু রাজ্য পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সহ আরও নানা বিষয়ে পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। ফলে স্বাধীনতার আগে থেকেই বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে গোর্খাল্যান্ডের দাবি। মর্লে-মিন্টো সংস্কার আন্দোলনের সময় গোর্খাল্যান্ডের জন্য পৃথক সংসদীয় ব্যবস্থার দাবি জানানো হয়েছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৫২ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কাছেও পাঠানো হয় দাবিপত্র। তবে এতকিছুতেই কোনো সুরাহা না হওয়ায় ১৯৮০-র দশকে লাগাতার আন্দোলনের পথ বেছে নেন গোর্খা ও নেপালি জনজাতির মানুষ। ১৯৮৮ সালে সুভাষ ঘিসিং-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে গোর্খা ন্যাশানাল লিবারেশন ফ্রন্ট।
অবশেষে আলাদা রাজ্যের দাবি না মিটলেও দার্জিলিং ও গোর্খাল্যান্ডের জন্য আলাদা কাউন্সিল তৈরি করা হয়। কিন্তু ২০০৪ সালে কাউন্সিল নির্বাচন বাতিল করা হলে আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাহাড়। সুভাষ ঘিসিং-কে নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় বহাল রাখার মাধ্যমে পাহাড়ের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই নষ্ট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। ঘিসিং-এর নিন্দায় সরব হন তাঁর দলের সমর্থকরাই। বিমল গুরুং-এর নেতৃত্বে এবার গড়ে ওঠে গোর্খা লিবারেশন অর্গানাইজেশন। গোর্খাল্যান্ডের দাবি সংবাদে উঠে আসে প্রত্যেক নির্বাচনের আগে। কিন্তু আজও তার সমাধানের কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন
'সূর্যোদয়' দেখতে চেয়েছিলেন নিবেদিতা, মৃত্যুর পর শুধু অবহেলাই দিল দার্জিলিং!
গোর্খাল্যান্ডের দাবি জাতীয় স্তরে উঠে আসতেই ওঠে পৃথক কোচবিহারের দাবিও। ব্রিটিশ শাসনেও এখানে রাজবংশের বিলোপ হয়নি। তবে ভারত স্বাধীনতা পেলে সি ক্যাটেগরির রাজ্য হিসাবে যোগদানের স্বীকৃতি জানায় রাজপরিবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোটা রাজ্য ভেঙে একটা অংশ আসে পশ্চিমবঙ্গে, একটা অংশ আসামে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা এবং আসামের কোকরাঝড়, বঙ্গাইগাঁও ও ধুবরি জেলাকে নিয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি ওঠে।
আরও পড়ুন
রসগোল্লার পর দার্জিলিং চা, বাংলার দখলে নতুন জিআই স্বীকৃতি
একইসঙ্গে উঠে আসে পৃথক কামতাপুরের দাবিও। অবশ্য এক্ষেত্রেও গোর্খাল্যান্ডের মতো জাতিগত কারণে পৃথক রাজ্যের দাবি ওঠে। প্রস্তাবিত কোচবিহার রাজ্য ছাড়াও আশেপাশের আরও বেশ কয়েকটি জেলাজুড়ে বাস রাজবংশী উপজাতির। এর সঙ্গে আরও বেশ কিছু উপজাতি সম্প্রদায়ের বাস কামতাপুর অঞ্চলে। কিন্তু এদের নিজেদের মধ্যে সংস্কৃতিগত যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও বাঙালি বা আসাম জনজাতির সঙ্গে সাদৃশ্য সামান্যই। এই দাবি থেকেই গড়ে ওঠে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা কেএলও-র মতো জঙ্গি সংগঠনও।
আরও পড়ুন
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ছেড়ে আজাদ হিন্দ ফৌজ, ফাঁসি হল গোর্খা মেজরের
তবে মানচিত্র বদলের দাবি সবসময় বিরোধমূলক নয়। মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের দাবি ছিল পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। ১৯৫৬ সালে তাই সত্যিই বদলেছিল মানচিত্র। রাজ্যে যুক্ত হয়েছিল পুরুলিয়ে জেলা। আবার ১৯৯৮ সালে ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠনের সময় সমগ্র মানভূম অঞ্চলকেই পৃথক করার দাবিও ওঠে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ভিতর দিয়ে গড়ে উঠেছে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। কিন্তু এরপর ৭৪ বছর কেটে গেলেও আজও এদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে জাতির ধারণা স্পষ্ট হয়নি। সেইসঙ্গে রাজধানী কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে জেলাগুলির বঞ্চনার ইতিহাস তো আছেই। তবে বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যই তো এ দেশের সংস্কৃতি।
Powered by Froala Editor