চলে গেলেন কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়। গতকাল, বৃহস্পতিবার রাত ১০.৫০ নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। গত পরশু রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল তাঁকে। সেখানেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় কাল। সোডিয়াম-পটাশিয়াম ইমব্যালেন্সের পর, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। এক কিংবদন্তির সমাপ্তি এভাবেই।
১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় উনিশ বছর বয়সে, দেশ পত্রিকায়। গল্পের নাম ছিল ‘হাড়কাটা’। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন পত্রিকায় গল্প, উপন্যাস, ধারাবাহিক উপন্যাস বেরনো শুরু। মানুষ খুন করে কেন, মফস্বলি বৃত্তান্ত, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য বই। শেষোক্ত উপন্যাসটির জন্য ১৯৯০ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
কলেজ থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া শুরু। পরবর্তীকালে রাজনীতি, কলেজে অধ্যাপনা, লেখালিখি - বিচিত্র ছিল জীবনের গতি। এসবের মধ্যেও একের পর এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত'। ঢেউ-খেলানো ডুয়ার্স। তিস্তা বয়ে চলে। বড়ো বড়ো জোত, চা-বাগান, ফরেস্ট… এখানেই রাজত্ব করে গিরি। সব তার দখলে। আর নদীর চর থেকে লড়াইয়ের আখ্যান বোনে বাঘারু। বেঁচে থাকার জন্য সে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে। তার পরিচয় এই বনের মতোই আদিম। 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত'-ও যেমন তিস্তার মতোই পাথুরে গিরিখাত ধরে বয়ে চলা এক মহাকাব্য। এমন মহাকাব্য সাম্প্রতিককালে হয়তো কেবল দেবেশ রায়ই লিখতে পারতেন।
আবার, 'মফস্বলি বৃত্তান্ত'-তে তিনি লিখছেন - 'কার্তিকের কুয়াশাঢাকা ধানি জ্যোৎস্নায় মায়া হয়। ধান কাটতে এখনো দেরি আছে। এ-আল ও-আল ধরে ধরে পাকা ধানখেতের পাকে পাকে নিজেকে পেঁচাতে পেঁচাতে ক্লান্ত, নিশ্চিত পায়ে, চ্যারকেটু এখনো দীর্ঘতর ক্ষুধার দিকে চলে যেতে থাকে।'
আসলে, খ্যাতির জন্য গল্প লেখেননি কোনোদিনই। নির্বিকল্প অতীত নয়, বহু বিকল্প অতীতকে বিশ্লেষণ করার প্রবণতা ছিল তাঁর। যেমন সিনেমার পর্দা সরে যায়, একের পর এক দৃশ্য আসে, ঠিক তেমনভাবেই দেবেশ রায়ের কথাসাহিত্যে উঠে আসত একের পর এক ফ্রেম। আর জন্ম নিত বিস্ময়। তিনি চলে গেলেন, কিন্তু পাঠকের জন্য থেকে গেল সেই বিস্ময়গুলোই। যা কোনোদিন ফুরনোর নয়...