গত শতাব্দীর বিশের দশক। পৃথিবীর বিজ্ঞানমহলে হাজির হয়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নামক এক বিস্ময় বিজ্ঞানী। নিজের মতো করে একের পর এক গবেষণায় মেতে আছেন তিনি। এমন সময় ভারত থেকে এক তরুণ বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র এসে পৌঁছয় তাঁর কাছে। তরুণের নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। প্ল্যাঙ্কের সূত্রকে খানিক অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি, যা দিয়ে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রমাণ করা সম্ভব। আইনস্টাইন মুগ্ধ হলেন। নিজেই সেই গবেষণাপত্রটি অনুবাদ করে প্রকাশ করে দিলেন। এবং এই কাজ করতে গিয়েই করে ফেললেন মারাত্মক একটি ভুল। লেখকের নামের জায়গায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু’র জায়গায় তিনি লিখে ফেললেন অন্য একটি নাম— ‘মিঃ ডি বোস’…
কে এই ‘ডি বোস’? বলা ভালো, ইনিও বাংলারই একজন বিজ্ঞানী। ‘মহান’ তকমা দিলেও খুব একটা ভুল হয় না। তাঁর নাম দেবেন্দ্রমোহন বসু। বাংলার বিজ্ঞান জগতের ‘তিন বসু’র একজন। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ পেয়েছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। বাবা মোহিনীমোহন ছিলেন ডাক্তার; সেইসঙ্গে প্রথম ভারতীয় যিনি আমেরিকায় গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন। কাকা আনন্দমোহন বসু তো সর্বজনবিদিত এক নাম। কিন্তু ভবিতব্যের এমন খেলা, বাবাকে জন্ম থেকে সেভাবে পেলেনই না দেবেন্দ্র। তখন তিনি নিতান্তই কিশোর। বাবাকে হারিয়ে অকূল পাথারে গিয়ে পড়লেন তাঁরা। ওপার বাংলা থেকে হাজির হলেন কলকাতায়। সেখানেই দেবেন্দ্র পেলেন আরেক অভিভাবককে। পেলেন নিজের আপন মামা, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু।
চোখের সামনে দেখছেন বিজ্ঞানের সাধনা। বেতার নিয়ে কাজ করার পর উদ্ভিদের প্রাণ নিয়ে গবেষণায় মগ্ন হলেন আচার্য জগদীশ বসু। একে একে আসছেন অন্যান্য বিজ্ঞানীরা, আসছেন ভগিনী নিবেদিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পরিমণ্ডলেই বেড়ে উঠলেন দেবেন্দ্রমোহন। বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা ছিল আগে থেকেই। এমন পরিবেশ পেয়ে সেসব আরও বিকশিত হতে লাগল। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে পাড়ি দিতেও বেশি সময় লাগল না। পদার্থবিদ্যার রাস্তাই তখন সম্বল দেবেন্দ্রমোহনের। সেই রহস্যই তাঁকে আকর্ষণ করছে তীব্রভাবে…
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরি। একের পর এক বিজ্ঞানের মোড় ঘোরানো গবেষণার কেন্দ্রস্থল; সঙ্গে কিংবদন্তি বিজ্ঞানীদের কাজের জায়গা। এক বিশাল ইতিহাস নিয়ে ইংল্যান্ডের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এই বীক্ষণাগার। সেখানেই হাজির হলেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। সামনে পেলেন জে জে থমসন, সি টি আর উইলসনের মতো নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের। ভেতরে ভেতরে যেন আরও প্রস্তুত হলেন তিনি। মাঝের কিছু বছর বাংলায় ফিরে, আবারও পাড়ি দিলেন জার্মানি। সেখানেই শুরু করলেন নিজের গবেষণা। এবারও সামনে পেলেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের মতো বিজ্ঞানীকে। দেবেন্দ্রমোহনের হাত ধরে বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞানচর্চা যেন অন্য মোড় দেখতে শুরু করেছিল। ক্যাভেনডিশ ল্যাবে যে ক্লাউড চেম্বার দেখেছিলেন, তাকেই আরও উন্নত করলেন তিনি। আর সেখানেই প্রত্যক্ষ করলেন পরমাণুর বিশেষ কিছু কণার অস্তিত্ব।
আরও পড়ুন
শসার খোসা থেকে প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরির দিশা দেখাচ্ছেন বাঙালি গবেষক
পরমাণু, তার ভেতরের কণা এবং মহাজাগতিক রশ্মি— দেবেন্দ্রমোহন বসু’র অবদানের কথা বলতে গেলে এই দিকগুলো অবশ্যই চলে আসবে। ১৯৩৮ সাল। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে হাজির হতে শুরু করলেন বিদেশের বিজ্ঞানীরা। সেই বছর এসেছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী ওয়াল্টার বাথও। দেবেন্দ্রমোহন বসুও উপস্থিত ছিলেন সেই অধিবেশনে। দুই বিজ্ঞানীর মিল হতে বেশি সময় লাগল না; সাঁকোর কাজটি করল মহাজাগতিক রশ্মি। এই বিষয় নিয়ে যে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তা নিয়ে একমত হলেন দুজনেই। কিন্তু কীভাবে এগোবে এই কাজ? ক্লাউড চেম্বার নয়; দেবেন্দ্রমোহনের মাথায় খেলছে অন্য একটি বস্তুর নাম— ফটোগ্রাফিক প্লেট।
কিন্তু প্রাথমিক জায়গাতেই গণ্ডগোল। সেই সময় দাঁড়িয়ে এমন গবেষণার উপযুক্ত ফটোগ্রাফিক প্লেট আনতে হত বাইরে থেকে। এদিকে বিপুল অর্থসাহায্যও করছেন না কেউ। সেজন্য কি বিজ্ঞান থেমে থাকবে? বিলেতের ইঙ্গফোর্ড ল্যাব থেকে উপযুক্ত হাফটোন প্লেট আনালেন দেবেন্দ্রমোহন। এরকম গবেষণার জন্য দরকার উঁচু এলাকা। ভালো হয়, যদি পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়া যায়। দার্জিলিং, সান্দাকফু, ফাড়ি জং— এই তিনটে জায়গায় ফটোগ্রাফিক প্লেট বসান দেবেন্দ্র। গবেষণায় সঙ্গী হিসেবে এগিয়ে এলেন আরেক বিজ্ঞানী, বিভা চৌধুরী। প্লেট ডেভেলপ করার পর দেখলেন কিছু আয়নিত গতিপথ। কিন্তু এই পথ চেনা নয়; প্রোটন কণার তো নয়ই। তাহলে কি নতুন কোন কণা? ১৯৪১ সাল। বিখ্যাত জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয় এই পুরো গবেষণা। বিজ্ঞানীমহলে আলোড়ন পড়ে যায়। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের বাইরেও আরও কণার অস্তিত্ব তাহলে আছে!
আরও পড়ুন
পৃথিবীর ‘শৈশব’ রয়েছে ভারতেই, প্রাচীনতম শিলা আবিষ্কার বাঙালি ভূতাত্ত্বিকের
মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, এমন মোড় ঘোরানো গবেষণার পর তো দেবেন্দ্রমোহন বসু ও বিভা চৌধুরীর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা। তা তাঁরা পাননি। প্রথমত, এই কণাকে সম্পূর্ণ শনাক্ত করার জন্য আরও গবেষণা করার দরকার ছিল। কণার ভর কত, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কোনো ধারণা করতে পারেননি তাঁরা। সেজন্য আরও অর্থবল, আরও উন্নত পরিকাঠামোর প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেসবের সুযোগ পাননি দেবেন্দ্রমোহন বসুরা। প্রায় একই সময় এই গবেষণা আরও উন্নতভাবে করেছিলেন বিজ্ঞানী সিসিল পাওয়েল। দেবেন্দ্রমোহনের খুঁজে পাওয়া কণাকেই সম্পূর্ণ রূপ দেন তিনি। বিজ্ঞানমহল প্রথমবার শুনল ‘মেসন’ কণার কথা। নোবেল পুরস্কার জুটল পাওয়েলের ভাগ্যে।
অবশ্য পরবর্তীকালে নানা জায়গায় দেবেন্দ্রমোহন বসুর অবদান স্বীকার করেছিলেন সিসিল পাওয়েল। আন্তর্জাতিক মহলও স্বীকৃতি দিয়েছিল এই ভারতীয় বিজ্ঞানীকে। এসবের বাইরে এলেও বাংলা ও ভারতের বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান ভোলার নয়। ১৯২৯ সালে নোবেল কমিটির কাছে মেঘনাদ সাহার নাম প্রস্তাব করেছিলেন স্বয়ং দেবেন্দ্রমোহন। আর সেইসঙ্গে চলে আসবে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কথা। তখন জগদীশচন্দ্র বসু সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। এত বড়ো গবেষণাকেন্দ্র একার হাতে দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। বিজ্ঞানচর্চার পীঠস্থান করে তুলেছিলেন একে। তাঁর প্রয়াণের পর কে দায়িত্ব নেবেন? শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জগদীশ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনিও যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিলেন দেবেন্দ্রমোহন বসুকে। ১৯৩৮ থেকে ১৯৬৭— দীর্ঘ ২৯ বছর তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত হন। বলা ভালো, বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কাজকে আরও নানা দিকে ছড়িয়ে দেন তিনি। ইতিহাস বলে, দেবেন্দ্রমোহনই সবথেকে বেশি সময় ওই পদে ছিলেন।
আরও পড়ুন
বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দেবেন ওষুধ; পাক বিমান অপহরণের চেষ্টা ফরাসি যুবকের
সেইসঙ্গে ছিল ভারতের আবহমান বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস। সে এক বিরাট কাজ। প্রথমে মেঘনাদ সাহার ‘সায়েন্স অ্যান্ড কালচার’ জার্নালে এই বিষয়টি নিয়ে লেখা শুরু করেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। ইতিহাসের পাতা থেকে নিয়ে এলেন একের পর এক কাহিনি। আমরা যা গবেষণা করছি সেটা তো আছেই; কিন্তু পুরনো সময়কে ভুলে গেলে তো চলবে না! তবে পত্রিকায় লেখা হিসেবেই নয়, ১৯৭১ সালে বই হিসেবেও বের করেছিলেন ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস। এমন মানুষটি আজ প্রায় বিস্মৃতির অতলে। গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানমহলের সঙ্গে ভারত ও বাংলাকে জুড়েছিলেন যারা, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে দেবেন্দ্রমোহন বসু’র নাম। কিন্তু আজকের সময় দাঁড়িয়ে কজন মনে করেছেন তাঁকে? ‘মেসন’ সম্পর্কে পড়াশোনা করতে গিয়ে কোনো বিজ্ঞানের ছাত্রও কি ভেবেছেন তাঁর কথা? ইতিহাসের বুকেই শেষমেশ স্নিগ্ধ আশ্রয় দেবেন্দ্রমোহনের…
তথ্যসূত্র- ‘বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু’, মানসপ্রতিম দাস, বিজ্ঞান
Powered by Froala Editor