ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনেই পার্লামেন্টে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রকাশ করলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। ইতিমধ্যে সেই বাজেট নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের অর্থনীতির রূপরেখা দেখলে এটুকু বোঝা যায়, এ-ধরণের বাজেট নিঃসন্দেহে সাহসী। বিশেষ করে বেসরকারিকরণের কথাটি যেভাবে জোরের সঙ্গে হাজির করা হয়েছে, তা সত্যিই ব্যতিক্রমী। ১৯৯৯ সালে যশবন্ত সিনহার বাজেটের পর এই প্রথম বেসরকারিকরণের পক্ষে খোলা সওয়াল করা হল বাজেটে। আর এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে ইতিমধ্যে নানা ধরণের বিতর্কও দানা বাঁধছে।
আসলে এই বিতর্কের পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, পরিবহণ সহ নানা ব্যবসায়িক ক্ষেত্র, যা এতদিন ব্রিটিশ সংস্থাগুলির অধীনে ছিল, তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো চিন্তা শুরু হয়ে গেল। সারা পৃথিবীতে তখন পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে ঘিরে বিতর্ক তুঙ্গে। ভারত অবশ্য এই দুই পথের একটিতেও হাঁটেনি। বরং তৈরি হল নতুন এক অর্থনীতির ধারণা। একে একে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রগুলি অধিগ্রহণ করল ভারত সরকার। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল, তাতে দেশীয় শিল্পপতিদের সঙ্গে কোনো সংঘাত শুরু হল না। বরং পাবলিক সেক্টরগুলির উন্নতির জন্য তাঁরাই এগিয়ে এলেন সবার আগে। আর এই বৈপ্লবিক অর্থনীতিই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির আদর্শ হয়ে উঠল।
এই সামান্য ভণিতার প্রয়োজন ছিল এই কারণে, যে সংঘাত স্বাধীনতার পরেই উপস্থিত হতে পারত তা আজ বাস্তব হয়ে উঠেছে। পাবলিক সেক্টরগুলির সঙ্গে দেশীয় শিল্পপতিদের রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, সমস্ত ক্ষেত্রেই সরকারি সংস্থাগুলি প্রতিযোগিতায় পিছু হটছে। বিএসএনএল-এর পরিষেবা আজ রীতিমতো ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখা যাচ্ছে বেসরকারি সংস্থা ‘রিলায়েন্স-জিও’-র বিজ্ঞাপনে। বিএসএনএল-এর অবস্থার অবনতির জন্য বারবার কর্মচারীদের উপর দোষ দেওয়া হলেও তাঁদের বকেয়া বেতন মেটানোর প্রশ্নে নিশ্চুপ থেকেছে কর্তৃপক্ষ। এয়ার ইন্ডিয়া, রেলওয়ে, ভারত পেট্রোলিয়াম সহ প্রায় সমস্ত পাবলিক সেক্টরের ক্ষেত্রেই এই কথা বলা যায়।
ঠিক এই পরিস্থিতিতেই চারটি স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র বাদে সমস্ত পাবলিক সেক্টর থেকে সরকারি লগ্নি তুলে নেওয়ার কথা জানালেন অর্থমন্ত্রী। এই চারটি স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র হল – ১। পরমাণু, মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা ২। যোগাযোগ ও পরিবহণ ৩। শক্তি ও খনিজ এবং ৪। ব্যাঙ্কিং ও ইন্সিওরেন্স। তবে এক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ বহাল থাকবে না, সে-কথাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বরং কমপক্ষে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখলে চলে, তাই যথেষ্ট। জীবন বিমা নিগমের অনেকটাই ইতিমধ্যে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এবার সাধারণ বিমা পরিষেবাতেও একই পথে হাঁটতে চলেছে সরকার। আর পরিবহণের মধ্যে রেল ও বিমান পরিবহণের বেসরকারিকরণের কথা তো আগেই উঠেছিল। এবারের বাজেটে সেটাই একরকম নিশ্চিত হয়ে গেল।
আরও পড়ুন
শুধু বেসরকারিকরণই নয়, রেলের রুটের ভাড়াও ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাই!
অর্থনীতির জন্য এই বেসরকারিকরণ কতটা যুক্তিযুক্ত তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। ভারতের সংবিধান প্রস্তাবনায় সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল। প্রস্তাবনা থেকে এই শব্দটি বাদ দেওয়ার কথা উঠেছে নানা সময়ে। বাস্তবে তা সফল না হলেও, এই বাজেট কার্যত সেই শব্দটিকেই উড়িয়ে দিল। ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। করোনা পরিস্থিতিতে যখন সাধারণ মানুষ জীবনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, তখনই ফুলে উঠেছে আম্বানি গোষ্ঠীর মুনাফার ভাণ্ডার। এই অবস্থায় সরকার সেই বৈষম্য মেটানোর চেষ্টা না করে তাকেই আরও প্রকট করে তুলছে না কি?
তাছাড়া বাজেটের শুরুতেই চারটি ক্ষেত্রকে স্ট্র্যাটেজিক ধরে নেওয়া হয়েছে। তবে বছরখানেক আগেই পার্লামেন্টে পেশ করা একটি বিলে ১৮টি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রকে স্ট্র্যাটেজিক বলে ঘোষণা করার কথা জানানো হয়। পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। তাহলে আবার সেই সংখ্যা ৪-এ নামিয়ে আনার কথা কেন উঠছে? অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন খুব তাড়াতাড়ি পার্লামেন্টে এই বিষয়ে বিল পাশ করানো হবে। প্রশ্ন হল, ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোতে পার্লামেন্টে একটি বিল পেশ করার পর তা পাশ নাও হতে পারে। তখন এই বাজেটের ভবিষ্যৎ কী হবে? অবশ্য বর্তমানে পার্লামেন্টে শাসক দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সেই সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু একই বিষয়ে এত দ্রুত মত পরিবর্তন সত্যিই অবাক করে। দেশের অর্থনীতি নিয়ে কী সত্যিই কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে? প্রশ্ন কিন্তু উঠবেই...
আরও পড়ুন
বেসরকারিকরণের থাবা বেঙ্গল কেমিক্যালসেও; হারাতে বসেছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মূলমন্ত্রই!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor