"বিবাহকে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কেন্দ্র দেখেছে, তার মধ্যেই একধরণের পুরুষতান্ত্রিকতা আছে। বিবাহকে সন্তান উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান হিসাবেই দেখা হয়েছে। কিন্তু যে-সমস্ত বিষমকামী মানুষ সন্তান উৎপাদনের জন্য বিবাহ করেন না, তাঁদের সম্পর্ককেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই রায়ের বিরোধিতা করছি।”
প্রহরকে বলছিলেন মনোবিদ অনুত্তমা ব্যানার্জি। প্রসঙ্গ, সমলিঙ্গ বিবাহ প্রসঙ্গে কেন্দ্রের অভিমত এবং অবস্থান। গতকাল দিল্লি হাইকোর্টকে কেন্দ্র সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, সমকামী বিবাহ ভারতের পরিবার ব্যবস্থার ধারণার পরিপন্থী। সরকারি হলফনামায় উল্লেখ করা হয়, ভারতে একমাত্র বিবাহের অধিকার রয়েছে ‘জৈবিক পুরুষ’ এবং ‘জৈবিক মহিলা’-র মধ্যেই। কেন না, এক মাত্র এই দাম্পত্যই সন্তান প্রজননে সক্ষম।
এর আগে অভিজিৎ আইয়ার-সহ তিন ব্যক্তি দ্বারস্থ হয়েছিলেন দিল্লি আদালতে। দাবি ছিল সমলিঙ্গ বিবাহকে হিন্দু বিবাহ আইন, বিশেষ বিবাহ আইন, এবং বিদেশি বিবাহ আইনের আওতায় আনা হোক। জমা দেওয়া হয়েছিল পিটিশন। আর তার ভিত্তিতেই আইনি বৈধতা নিয়ে কেন্দ্রকে নোটিশ জারি করেছিল আদালত। তবে গত নভেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করা হলেও কোনো উত্তর মেলেনি কেন্দ্রের তরফে।
প্রশ্ন থেকে যায় অন্য জায়গায়। যেখানে সমকামিতাকে বছর দুয়েক আগেই বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ভারতে সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি না দেওয়া তো এক প্রকার দ্বিচারিতাই। অর্থাৎ বৈধ হলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহবাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে সমকামীদের।
আরও পড়ুন
সমলিঙ্গ বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দিতে নারাজ কেন্দ্র, কী বলছেন বাংলার বিশিষ্টজনেরা?
ঠিক সেই জাগাটাতেও আঙুল তোলে কেন্দ্র। উঠে আসে যুগলের লিভ ইন এবং সম্পর্কের প্রসঙ্গও। সরকারের মতে, সমকামিতাকে ৩৭৭ ধারার ফৌজিদারি আইনের বাইরে আনা হলেও তাকে ‘মৌলিক অধিকার’ হিসাবে বলা যায় না। সেইসঙ্গে কেন্দ্র এও স্পষ্ট করে দিয়েছে, এই আইন প্রণয়নের দায়িত্ব আদালত তুলে নিতে পারে না। একমাত্র আইনসভার নির্বাচিত সদস্যরাই সমকামী বিবাহকে বৈধ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
আরও পড়ুন
সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি গির্জার, নতুন যুগের সূচনা ফিদেল কাস্ত্রোর দেশে
অন্যদিকে ২০১৫ সালে সমলিঙ্গ বিবাহে আবদ্ধ হয়েছিলেন কলকাতার সুচন্দ্রা দাস ও শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়। সুচন্দ্রা দাস মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্যেও উঠে এল সরকারের এই বিরুদ্ধাচরণের কথাই, “৩৭৭ যখন অ্যাবলিশ করা হয়েছিল, তখন কেন্দ্র কিন্তু চুপচাপই ছিল। সেটা তখন কেন্দ্রের আওতায় থাকলে হয়তো এই রায় আসত না। আর আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে অনেকেই নিজেদের অ্যালাই বলছেন, হয়তো মনে হচ্ছে আমরা এগচ্ছি। তবে সোশ্যাল এক্সপিরিয়েন্স থেকে বুঝতে পারি সামগ্রিক মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি সেভাবে। আমার আসেপাশের মানুষকে তাঁদের মতো করে থাকতে দিচ্ছি, সেই অ্যাকসেপ্টেন্সের জায়গা তৈরি হয়ে ওঠেনি এখনও। সেটাই পরিষ্কার করে দেওয়া হল যে তোমরা ট্যাক্স দেবে কিন্তু মৌলিক অধিকারের জন্য গলা ফাটাতে পারবে না।”
আরও পড়ুন
‘আইন, সমাজ সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দেয় না’, মন্তব্য কেন্দ্রের
তবে ধন্দ রয়ে যাচ্ছে অন্য একটি জায়গায়। যে ‘হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট’-এর কথা উঠে আসছে বারবার, সেখানে উল্লেখ রয়েছে দু’জন হিন্দু ব্যক্তির মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে। বিসম লিঙ্গের কোনোরকম শর্ত কিন্তু আরোপিত নেই সেখানে। একই রকমভাবে আবেদনকারীদের দাবি ‘স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট’ এবং ‘ফরেন ম্যারেজ অ্যাক্ট’-এর আওতাতে সমকামী বিবাহকে আনায় কোনো যৌক্তিক অবৈধতা নেই।
“আমাদের দেশের আইন-আদালত বলা হোক কি পার্লামেন্ট বলা হোক, সবটাই তো একটা সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক পরিকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যা মূলত পিতৃতান্ত্রিক এবং আধা-পূঁজিবাদি একটি ধাঁচা। একজন মহিলা এবং তার গর্ভের ওপরে পুরুষের অধিকার। এভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে গোটা সিস্টেম। আর সেখানেই ব্যক্তিসম্পত্তির মালিকানা এবং পিতৃতন্ত্রের বোধ একে অপরকে অঙ্গাঙ্গিভাবে পুষ্ট করছে। এই ধাঁচাটাকেই বজায় রাখার জন্য এই ধরণের গল্পগুলো সাজানো হচ্ছে সরকারের তরফে। স্বাভাবিকভাবে সমলিঙ্গ বিবাহে কোনো সন্তানের ব্যবস্থা নেই, ফলে পুরো সিস্টেমটায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। আর সেটাই উঠে এসেছে সরকারের বক্তব্যে”, সরকারের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বললেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রান্তকথার কর্ণধার ও এলজিবিটি আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়।
কথায় উঠে আসছে, এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র শুধু সমকামিতা কিংবা দু’জন মানুষের একসঙ্গে থাকার অধিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং বৃহত্তর অর্থে তা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের চাবিকাঠি।
মনোবিদ অনুত্তমা ব্যানার্জির কথায়, “আমরা জানি জন্মগত লিঙ্গচিহ্নই যে মানুষের একমাত্র পরিচয় নয়, তা নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক ও মনঃস্তাত্বিক ধারণা আছে। এর বাইরে গিয়ে মানুষকে দেখার কথাও বারবার উঠে এসেছে। সেইসঙ্গে নারী-পুরুষ লিঙ্গচিহ্নের বাইরে গিয়ে লিঙ্গসাম্যের যে লড়াই, তাকেও কেন্দ্র অপমান করল। আমি আশা করব, ৩৭৭ ধারার ক্ষেত্রে আদালত যেমন তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে, এক্ষেত্রেও সেই পরিবর্তন আসবে। তবে তার জন্য অনেকখানি লড়াই বাকি আছে।"
আবার অভিনেতা ও বাচিকশিল্পী সুজয়প্রসাদের কথায়, "আদালতের রায়ের উপর আমার কোনোদিনই তেমন আস্থা ছিল না। আমার ব্যক্তিগত বা শৈল্পিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো অধিকার কোনো প্রতিষ্ঠানের থাকা উচিৎ বলেই বিশ্বাস করি না। যা মানুষকে নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে শেখায়, তার উপরে নৈতিকতার প্রসঙ্গ আরোপ করা রীতিমতো অন্যায়। আর আদালত যে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা বলেছে, সেটাকে তো রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে আজকাল। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবই রসাতলে গিয়েছে। আদালত হয়তো আবারও আন্দোলনের চাপে মত পরিবর্তন করবে। কিন্তু আসল লড়াই সামাজিক অধিকার আদায় করা। তার জন্য সচেতনতা গড়ে তোলাই আজকের দিনে সবচেয়ে জরুরি।"
আগামী ২০ এপ্রিল পুনরায় শুনানির দিন ধার্য হয়েছে আদালতে। সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন আবেদনকারী এবং আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরা।
Powered by Froala Editor