১ অক্টোবর থেকে নয়া নির্দেশিকা ফেসবুকের; গুজব রুখতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতায় কোপ?

দেশে-বিদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে ঘিরে একাধিক বিতর্কের মধ্যেই নতুন ঘোষণা করল মার্কিন এই বহুজাতিক সংস্থা। ফেসবুকে একই মেসেজ একাধিক অ্যাকাউন্টের কাছে ফরওয়ার্ড করা যেমন সীমিত করা হচ্ছে, তেমনই কী ধরনের কনটেন্ট পোস্ট করা হচ্ছে ওয়ালে, সেই দিকেও তীক্ষ্ণ নজর থাকবে ফেসবুকের। জানানো হয়েছে, ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মেসেজ একবারে পাঁচ জনের বেশি কাউকে ফরওয়ার্ড করা যাবে না। বিভ্রান্তিকর এবং ভুল তথ্যের ছড়িয়ে-পড়া আটকাতেই এই মূলত এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে সংস্থা। এর আগে ফেসবুক অধিকৃত হোয়াটসঅ্যাপে কার্যকর করা হয়েছিল এই নীতি। সেই পথে হেঁটেই এবার খুব তাড়াতাড়ি সারা বিশ্বেই এই নিয়ম কার্যকর করতে চলেছে ফেসবুক।

ফেক নিউজে রাশ টানতে দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকের কাছে তদ্বির জানানো হচ্ছিল নানা মহল থেকে। সেই বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দীর্ঘদিন টালবাহানা করলেও, অবশেষে এই পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জুকারবার্গ। সেই সঙ্গেই জানানো হয়েছে আগামী ১ অক্টোবর থেকে লাগু হতে চলা নতুন নিয়ম। জুকারবার্গ জানিয়েছেন,  ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে যদি এমন কোনও কনটেন্ট প্রকাশিত হয় যার ফলে সংস্থার আইনি বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলে সেই কনটেন্ট ব্যবহারকারীকে জিজ্ঞাসা না করেই সরিয়ে দিতে পারবে ফেসবুক। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে হইচই শুরু হয়েছে সর্বত্র। একপক্ষ এর ফলে সাধুবাদ জানিয়েছেন ফেসবুককে। অপরদিকে গ্রাহকের স্বাধীনতা এবং অধিকার খর্ব হওয়ার অভিযোগে সংস্থাকে একহাত নিতেও ছাড়েননি অনেকে।

ফেসবুকের এই নীতিকে সমর্থনকারীদের বক্তব্য, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একাংশের ধর্মীয় মৌলবাদ, হিংসাত্মক অথবা উত্তেজক মন্তব্যের কারণে সারা পৃথিবী জুড়েই অসংখ্য মামলা সামলাতে হয় ফেসবুককে। সেগুলি এই ব্যবস্থার ফলে মেটানো যাবে অবশেষে। এর ফলে সংস্থার খরচ এবং সময় দুটোই বাঁচবে। ফলে গ্রাহকদের আরও উন্নত পরিষেবা প্রদানের দিকে নজর দিতে পারবে সংস্থা।

অন্যদিকে প্রশ্ন উঠেছে ব্যক্তিস্বার্থে নাক গলানোর কারণে। ব্যবহারকারীকে না জানিয়েই তার অ্যাকাউন্টে হস্তক্ষেপ আসলে তো ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরে হাত দেওয়ারই সামিল। মতের অমিল থাকতেই পারে। কিন্তু তা বলে যদি সেই মত প্রকাশের জায়গাটিকেই নষ্ট করে দেওয়া হয়, তাহলে বিষয়টা তো দাঁড়াচ্ছে সেই একনায়কতন্ত্রেরই! প্রশ্ন উঠছে, কীসের প্রেক্ষিতে বিচার করা হবে যে, কোন পোস্টটি ভালো, আর কোনটি ক্ষতিকর? যারা এই কাজটি সংস্থার হয়ে করবেন, তারা যে কোনোভাবেই পক্ষপাত দোষে দুষ্ট নন, তার নিশ্চয়তা সংস্থা দিচ্ছে কি?

আরও পড়ুন
বদলে যাচ্ছে এতদিনের ফেসবুক, আগামী মাস থেকেই নতুন চেহারায় কম্পিউটার স্ক্রিনে

এছাড়াও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে হতে চলা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন সীমিত করার ঘোষণাও করা হয়েছে ফেসবুকের তরফে। মূলত নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে উত্তেজনা ও অস্থিরতা প্রশমন করতেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানানো হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই ফেসবুকের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ফলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল সংস্থাকে। বিশেষ করে ফেসবুকের নিয়ম-নীতি রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে খাটে না, তারা যেমন খুশি মত প্রকাশ করতে পারেন ফেসবুকে, জুকারবার্গের এই বক্তব্যে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল ফেক নিউজ এবং তাকে কেন্দ্র করে একাধিক গোষ্ঠী সংঘর্ষ অথবা গণপিটুনিতে মৃত্যুর মতো ঘটনা।

আরও পড়ুন
ভারতের মধ্যেই আস্ত 'পাকিস্তান': গুজব নয়, সত্যি

অন্যান্য সংস্থা যেমন টুইটার বা গুগল এই ক্ষেত্রে আরও কঠোর নিয়ম নিয়ে এসেছে। কিন্তু বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি ফেসবুকের। এমনকি আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর বর্ণবাদী আচরণের জন্য সারা বিশ্বের প্রতিবাদের সামনেও ফেসবুক অবিচল ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত বক্তব্য টুইটার থেকে মুছে দেওয়া হলেও ফেসবুক কিন্তু হাত দেয়নি তাতে। ফেসবুকের এমন মনোভাবকে ‘অন্যায়ের সমর্থনকারী’ এবং ‘উদ্ধত’ বলেও অভিহিত করা হয়েছিল কোনও কোনও মহলে।

আরও পড়ুন
গুজব এড়াতে যে পদক্ষেপ নিল হোয়াটসঅ্যাপ

ফেসবুকের এই নীতির বিরুদ্ধে তারপর থেকে এই প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন বর্জনের ডাক দিয়ে সরে গেছে কোকাকোলা বা ইউনিলিভারের মতো সংস্থা। যদিও তার ফলেই এই সিদ্ধান্ত কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সার্বিক পরিস্থিতি কিছুটা হলেও চাপে রেখেছে ফেসবুককে। ফলে ফেসবুকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখন থেকে সম্ভাব্য ক্ষতিকর পোস্টে বিশেষ ‘লেবেল’ বা ‘বার্তা’ লাগিয়ে দেওয়া হবে।

সুতরাং ফেসবুকের যুক্তি যাই থাক না কেন, কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না এই সিদ্ধান্তের ধূসর দিকগুলিকে ঘিরে ডানামেলা সন্দেহ। আমেরিকা বা ভারতের মতো বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশগুলিতে একটু কাকতালীয়ভাবে হলেও সরকারের পক্ষে হেলে থাকতে দেখা গিয়েছে ফেসবুককে। তাই আখেরে ফেসবুকের এই সিদ্ধান্ত কতটা স্থিতি আনবে সমাজে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু বিশ্বের মত প্রকাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান যাতে পক্ষপাতহীন এবং নির্মমভাবে সঠিক ও সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে পারে, সেই আশাই থাকবে ফেসবুকের কয়েকশো কোটি গ্রাহকের।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More