তিনি ছিলেন পিতা-মাতার অষ্টম গর্ভের সন্তান। তাই নাম রাখা হয় দেবকীনন্দন। পিতা মধুসূদন বসু ছিলেন বর্ধমানের কৈগ্রামের বর্ধিষ্ণু জমিদার বংশের সন্তান। অন্যদিকে মা গোপীসুন্দরী দাস ধর্মমতে পরম বৈষ্ণব। মায়ের সূত্রেই দেবকীকুমার বসু (Debaki Kumar Bose) আকৃষ্ট হন বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি। পরবর্তী জীবনের প্রতিটি আচরণে পালন করেছিলেন সেই উদারতা ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা। গ্রামে কলেরা দেখা দিলে ছুটে যেতেন বাড়িতে বাড়িতে। প্রতিবাদী হয়েছিলেন নিজেদের জমিদারি পরিবারের বিরুদ্ধেও। বিতাড়িত দেবকী সংসার চালাতে কয়লার ব্যবসা করেছেন, গামছা বিক্রি করেছেন রাস্তায়। অথচ তাঁর হাতেই বাংলা তথা ভারতবর্ষের সিনেমা প্রথমবার সম্মানিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
১৮৯৮ সালে শক্তিগড়ের অকালপৌষ গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম দেবকী বসুর। গ্রামের জীবন কাটিয়ে আই.এ পাশ করেন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন। বি.এ পড়া বন্ধ রেখে দেবকী জড়িয়ে পড়লেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। ছাড়তে হয় কলেজও। কিছুদিন পর সাংবাদিকতা শুরু করেন সাপ্তাহিক ‘শক্তি’ পত্রিকায়। ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে তাঁর সম্পাদনায় ‘শক্তি’ হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী কণ্ঠস্বরের অন্যতম প্রধান মঞ্চ।
সেই সময়েই কিছুটা কাকতালীয়ভাবে আলাপ হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ডি.জি’ অর্থাৎ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পুরনো সিনেমা সংস্থা থেকে অপমানিত ডি.জি তখন সদ্য তৈরি করেছেন ‘দ্য ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি’-র। নতুন সিনেমার জন্য টাকার সন্ধানে তিনি গেলেন বর্ধমানে এক বন্ধুর বাড়িতে। সেখানেই আলাপ এক বছর তিরিশের যুবকের সঙ্গে। বাবরি চুল, নম্র স্বভাব, কথা বলেন ধীরে কিন্তু যুক্তিপূর্ণভাবে। সিনেমা নিয়েও চর্চা বিস্তর। সবচেয়ে বড়ো কথা যুবক প্রবল পরিশ্রমী। জহর চিনতে ভুল হয়নি জহুরীর। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এলেন কলকাতার ২১ নং মোহনলাল স্ট্রিটের বাড়িতে। দুই কিংবদন্তি শিল্পীর যুগলবন্দিতে শুরু হল বাংলা সিনেমার জয়যাত্রা।
ডি.জি-র প্রযোজনায় ১৯৩০ সালে ‘পঞ্চশর’ সিনেমায় পরিচালক হিসেবে প্রথম আবির্ভাব দেবকীর। যদিও আগের বছরই নায়ক রূপে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল ‘কামনার আগুন’ বা ‘ফ্লেমস অব ফ্লেশ’ ছবিতে। এই ছবির চিত্রনাট্যকারও ছিলেন তিনি। এরপর একটি চলচ্চিত্র তোলেন লক্ষ্মৌয় গিয়ে। পরে প্রমথেশ বড়ুয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তি পায় ‘অপরাধী’ ছবিটি। এই সিনেমাতেই প্রথম কৃত্রিম আলোর ব্যবহার করেন দেবকী। তিনি তখন কাজ করতে শুরু করেছেন বীরেন্দ্রনাথ সরকারের নিউ থিয়েটার্সে। সিনেমা জগতেও একটা পরিবর্তন আসছে। নির্বাক থেকে ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠছে চলচ্চিত্র। নতুন যুগের শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ করলেন তিনি। বুঝলেন, নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ শেষ। সিনেমা তৈরি করতে হলে শুধু ভাষা নয়, তাঁকে সাজিয়ে দিতে সুর ও ছন্দের লাবণ্যে।
আরও পড়ুন
গান গাইতে হবে পরবর্তী সিনেমায়, সুমিত্রার কাছে অনুরোধ উত্তমকুমারের
১৯৩২ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘চণ্ডীদাস’। কী নেই সেই ছবিতে? দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর উমাশশীর অভিনয়, বাইচাঁদ বড়াল কর্তৃক প্রথম আবহসঙ্গীতের ব্যবহার, সংলাপের মুনশিয়ানা। দর্শক মোহিত হয়ে গেল সবাক সিনেমার চূড়ান্ত রূপ দেখে। একই সঙ্গে এটি ছিল ভারতের প্রথম ছবি যা ‘সিলভার জুবিলি’ করে। এ বছরই হিন্দিতে মুক্তি পেয়েছে তাঁর ছবি ‘পুরাণ ভকত’। জনপ্রিয়তার একেবারে শীর্ষে পৌঁছে গেছেন দেবকী। ‘শনিবারের চিঠি’-তে সজনীকান্ত দাস লিখছেন, “সেই সময় বাংলার ঘরে ঘরে উচ্চারিত হতো তিনটি নাম—নেতাজী সুভাষ বসু, মোহনবাগান আর দেবকী বসু।” অন্যদিকে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ‘নিউ থিয়েটার্স’কেও দাঁড়াতে সাহায্য করেছে শক্ত মাটিতে। ‘হিট’ বলতে কী বোঝায়, তার প্রথম নমুনা ছিল ‘চণ্ডীদাস’ ও ‘পুরাণ ভকত’। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়েই বীরেন্দ্রনাথ সরকার বলেছিলেন, “দেবকীবাবুর কাছে আমরা ‘গ্রেট-ফুল বোথ ইন বেঙ্গলি অ্যান্ড হিন্দি মার্কেট। তিনি আমাদের ওভারঅল ইস্টাবলিশড করে দিয়ে গিয়েছিলেন।”
আরও পড়ুন
নির্বাক যুগেও একটি সিনেমার আয় সাত লক্ষ টাকা, নেপথ্যে হাওড়ার জ্যোতিষচন্দ্র
১৯৩৪ সালে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘সীতা’। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয় ছবিটি। দেবকী বসুই প্রথম ভারতীয় পরিচালক যিনি প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই সঙ্গে ভারতীয় সিনেমাও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিদেশের মাটিতে। এখানেই শেষ নয়। ১৯৫৯ সালে ‘সাগর সঙ্গমে’ মনোনীত হয় ‘গোল্ডেন বেয়ার’ পুরস্কারের জন্য। যে তালিকায় ছিল আকিরা কুরোসয়া ও সিডনি লুমেটের সিনেমাও। দেশে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক লাভ করে সিনেমাটি। সম্মানিত হয় সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারেও। পদ্মশ্রী উপাধির পাশাপাশি অর্জন করেন ‘চলচ্চিত্র ভারতী’ উপাধি। তৈরি করেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘চলচ্চিত্র ভারতী’। চলচ্চিত্র জগতের প্রায় সকলেই তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘চিত্রসন্ন্যাসী’ বলে।
সে তো অনেক পরের কথা। তার আগেই ‘মেঘদূত’, ‘কৃষ্ণলীলা’, ‘কবি’, ‘রত্নদ্বীপ’, ‘আপনা ঘর’, ‘চন্দ্রশেখর’-এর মতো অসামান্য সিনেমায় সাড়া ফেলে দেন দেশজুড়ে। তাঁর পরিচালনার গভীর অনুরাগী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, “জানাবে প্রণতি ভাবী ভারতের/ যারা লয়ে তব নাম/ তাহাদের সাথে নিবেদিত হয়ে/ রহিল মোরও প্রণাম—”। নজরুলের ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেছে অক্ষরে অক্ষরে। ভাবীকালের চলচ্চিত্রের পথনির্মাণ করে গেছিলেন তিনি। ভারতের সিনেমাকে সবদিক থেকে পরিপূর্ণ করে ‘আধুনিক’ করে তোলার অন্যতম রূপকার দেবকী বসু।
ঋণস্বীকার :
তিনি ছিলেন ভারতীয় সিনেমার আচার্য, এক বৈষ্ণব চলচ্চিত্রকার, সুদেষ্ণা বসু, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ এপ্রিল, ২০১৯
সোনার দাগ, গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ
Powered by Froala Editor