ইটনা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন কালীমোহন বিশ্বাস। দীর্ঘদিন ধরে বসবাস সেখানে। যে সময়ের গল্প, সেই সময়টা বাংলার ইতিহাসে ‘নবজাগরণ’ হিসেবে ধরা আছে। নানা ঘটনার ঘনঘটায় নতুন ভোর তৈরি হল বাংলায়। এল সামাজিক বদল। আর সেই সূত্রেই তৈরি হল ব্রাহ্ম ধর্ম। অন্যান্য অনেকের মতোই কালীমোহনও ব্রাহ্ম ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেন; এবং শেষ পর্যন্ত সেই ধর্মও গ্রহণ করলেন। ফলস্বরূপ, দীর্ঘদিনের বসবাসের গ্রাম থেকে সপরিবারে বিতাড়িত হতে হয় তাঁকে। ‘ম্লেচ্ছ’দের নাকি গ্রামে রাখা যাবে না!
এই ঘটনার বেশ কিছু পরের ঘটনা। এই ‘ম্লেচ্ছ’ পরিবারেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল সুরের জগত। ঠিক যেন আসল মানুষটি আসার আগে মঞ্চ প্রস্তুতি চলছে। ছেলে দেবেন্দ্রমোহনের কোলে জন্ম নিল ফুটফুটে পুত্রসন্তান। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সবসময় ছায়া ফেলেছে বিশ্বাস পরিবারে। সব যখন ঠিক চলছিল, তখন দেবেন্দ্রমোহনের স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়ে স্থানীয় গির্জায় নিজের ছেলেকে দিয়ে এলেন। ব্রিটিশ আমল তখন, আর ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বিরাজ করছেন রাজা পঞ্চম জর্জ। কাজেই এই ছেলের নতুন একটি নামও ঠিক হয়ে গেল। ‘জর্জ’! কালে কালে যে নামের সঙ্গে বেড়ে উঠবে বাংলার সঙ্গীত জগতের একটা যুগ। দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনে এইভাবেই ছায়া ফেলেছেন বিভিন্ন দেবতা। তবে জীবনদেবতার পাশে যিনি বসে আছেন, তাঁকে আঁকড়ে ধরেই তো সারাটা জীবন বেঁচেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ও দেবব্রত ‘জর্জ’ বিশ্বাস— জীবন মঞ্চে ঘুরে ফিরে এসে এক হলেন দুই ‘ম্লেচ্ছ’ ব্রাহ্ম!
দেবব্রত বিশ্বাস নিজেই একটি মিথ। শুধু সুর-আশ্রিত জীবন ছিল না; সুরের ভেতর, কথার ভেতর যদি আত্মাটাই না থাকে তবে ‘ক্যামনে হইব’? এ এক দীর্ঘ বটবৃক্ষের জীবন; যেখান থেকে নেমে এসেছে একের পর এক গল্পের ঝুরি। দেবব্রত’র সঙ্গে জুড়ে আছেন আরও নানা মানুষ। সবাই তো স্রোতের বিপরীত দিকের যাত্রী। যেমন জর্জ, তেমনই ছিলেন আরেক ‘পাগল’। ঋত্বিক ঘটক। দেবব্রত বিশ্বাসের নানা রূপ চিনতেন তিনি। যেমন জানতেন প্রবল তাস খেলার নেশার কথাও। তাও যে সে ভাবে নয়, রীতিমতো টাকা-পয়সা দিয়ে খেলা। গানে যেমন সিরিয়াস, তাসেও তেমন। ঋত্বিক হয়তো ফাঁকতালে ঢুকে পড়েছেন, কাউকে তোয়াক্কা না করে চলে গেছেন সোজা জর্জের কাছে। সোজা এক ধমক, “আমি জিততাছি, তুমি আমার কপালডার বারোটা বাজাইয়া ছাড়বা।” দেবব্রত বিশ্বাস আবার কপাল টপালও মানে নাকি! ঋত্বিকের সরল মন্তব্যে বলতেন, “মানি, মানি সব মানি… শুধু তোমারে মানি না।” তবে যেদিন জিততেন, সেদিন আর তাঁকে দেখত কে! পরের দিন বাড়িতে লেগে যেত ভোজের আসর।
এই ঋত্বিক ঘটকই একবার পড়লেন মহা বিপদে। তাঁর সিনেমার সঙ্গে জুড়ে থাকত দেবব্রত বিশ্বাসের গান। দুয়ে মিলে যেন অন্য এক জগত! ঋত্বিকের মাথায় আরেকটা ছবি ঘুরছে। সেটা নিয়েই কাজের কথা চলছে; নাম রেখেছেন ‘কোমল গান্ধার’। যথারীতি এবারও গেছেন দেবব্রত’র কাছে। তাঁর গান, তাঁর গলা যে চাই পর্দায়। হঠাৎ বেঁকে বসলেন দেবব্রত বিশ্বাস। “না, তুমার সিনেমায় আমি গান গামু না।” কেন? কী হল হঠাৎ? না, ঋত্বিক সিনেমায় সবাইকে দেখাবেন, সবাই অভিনয় করবেন; আর তিনি কিনা থাকবেন নেপথ্য শিল্পী। সেটি হচ্ছে না!
আরও পড়ুন
‘তোমার স্টাইলে গানটা রেকর্ড করলাম’ – চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে লিখে দিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
ঋত্বিক প্রথমে ভেবেছিলেন জর্জ বোধহয় হালকা মেজাজে আছেন। তাই এমন কথা বলছেন। কিন্তু শেষে দেখলেন, না, ব্যাপার অত্যন্ত সিরিয়াস! দেবব্রত বিশ্বাসের জেদ, শুধু গান গাইবেন না; ঋত্বিকের সিনেমায় অভিনয়ও করবেন। একেবারে সপাট বক্তব্য তাঁর, “আমারে দিয়া গান করাইতে যুদি চাও আমারে পার্ট দেওয়া লাগব। আমি ভালোই অভিনয় করি…”। অগত্যা রাজি হলেন ঋত্বিক; কথা বলারই পার্ট দেবেন তাঁকে। শুনে তো খুশিতে একেবারে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে অভিনয় করবেন বলে কথা!
যেদিন গান রেকর্ডিং হবে, সেদিন আরেক কাণ্ড। সকাল দশটা বেজে গেল, দেবব্রত বিশ্বাস তখনও ঘরে বসে। ছোটবোন ললিতা জিজ্ঞেস করছেন, কী রে যাবি না স্টুডিওতে? দেবব্রত বসেই রইলেন। শেষে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন স্বয়ং ঋত্বিক। কী হল? শরীরও সুস্থ, সব ঠিক আছে; অথচ স্টুডিওতে দেখা নেই। জর্জ বিশ্বাসের মাথায় তখন ঘুরছে অন্য চিন্তা। যেতে পারেন; কিন্তু একটা শর্তে। সবাইকে বিপদে ফেলেন যে ঋত্বিক, তিনি নিজেই এবার বিপদে। কী শর্ত? ‘কোমল গান্ধার’ ছবির নায়িকা সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে একই সিনে তাঁকে দেখাতে হবে। সুপ্রিয়ার সঙ্গে একই সিনে অভিনয় করবেন তিনি। “না হইলে আমারে তুমি চাকর-বাকরের পার্ট দিয়া দিবা।” শেষ পর্যন্ত রাজি হন ঋত্বিক; আর তারপরই বাড়ি থেকে বেরোন দেবব্রত বিশ্বাস। সেই সিনেমাতেই ওঁর গাওয়া ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ গানটার কথা আজও কি ভুলতে পেরেছে বাঙালি?
আরও পড়ুন
হেমন্ত যদি চিনা খবরের কাগজও সুর করে পড়ে, লোকে শুনবে - বলেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
এমনই ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। নিজের খেয়ালেই মেতে আছেন। সেখানে বাজছে নিজের সুর, ভেলায় ভেসে আছেন; সেখানে ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-এর সেই গানটা? ‘কেন চেয়ে আছ গো মা”— কীসের আকুতি জড়িয়ে পড়েছিল গলায়? এই গানটাই নাকি মদ খেয়ে গাওয়ার কথা বলেছিলেন ঋত্বিক। রবীন্দ্রনাথের গান মদ খেয়ে? কক্ষনো এমনটা করবেন না দেবব্রত বিশ্বাস। তাঁর ছাত্র সুশীল বরং এই গানটা করুক, বড়ো ভালো গায় ছেলেটা! ঋত্বিক গোপনে রেকর্ড করে নিলেন জর্জের গলা। রেগে গেলেন তিনি। কিন্তু ঋত্বিকের ওপর কি রাগ করে থাকা যায়? তাঁর নিজের ওপরও যায় কি!
তথ্যঋণ— ‘বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে’/ বাসব দাশগুপ্ত
Powered by Froala Editor