এমন বৃষ্টির দিনে ছাতা নিয়ে গলির মুখে বসে যেতেন জর্জ বিশ্বাস। ডেকে নিতেন নাতনিদের। ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের সেই ঘরে তখন বাসা জর্জ বিশ্বাসের। মশারি টাঙিয়ে ঘুমোন। ঘুম অবশ্য প্রায়ই ছেনালি করে। শ্বাসকষ্ট তো, তাই… বিছানার ওপরেই বইপত্র ছড়ানো। ক্যাসেট, রেডিও, ছোটো টিভি বইয়ের সেলফে স্বরবিতান। টুলের ওপর হারমোনিয়াম। শুলে শ্বাসকষ্ট বাড়ে। ইনহেলারেও শান্তি আর মেলে কই! ফলে, ইজিচেয়ারে শরীর ছেড়ে দিলেই ঘুম চলে আসে। আর আসে ছাত্র-ছাত্রী, আসে গান। বর্ষাকালে বৃষ্টিও আসে। এমন ঋতু আর নেই।
বৃষ্টির দিন মেজাজটাও ভিজে তরতাজা হয়ে থাকত জর্জ বিশ্বাসের। গান শেখানোর সময় জিভে চেটে নিচ্ছেন অল্প চুন। ফের শুরু করছেন গান ‘এ কী গভীর বাণী এল’। ছাত্র অর্ঘ্য সেন একদিন হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘‘জর্জদা, রেসের মাঠে যান কেন?’’ জর্জ তাকালেন তাঁর দিকে। ‘‘তুমি বিয়া করো নাই কেন? তুমি যেমন বিয়া করো নাই, আমি তেমনই রেসের মাঠে যাই। এটা আমার চয়েস।’’
অদ্ভুত মানুষ ছিলেন বটে। গান শিখতে আসেন গীতা ঘটক। সেই সময় অন্য কেউ আর শিখবে না। অন্য সময়ে আসেন আরতি, ইন্দ্রাণীরাও। গান শেখাতে শেখাতে রাত হয়ে গেলে ছাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে আসতেন বাড়িতে। নিজের বাইকে চাপিয়ে। কলকাতার রাস্তায় তখন রাত বাড়লে লোকজন কমে আসত। আর সেই রাস্তা ধরে শাঁ শাঁ করে ছুটত জর্জ বিশ্বাসের বাইক। ভয় পাওয়া নিষেধ। ছাত্রী শ্রীলা সেন একদিন সেই বাইকের পিছনের সিটে। গতি বাড়ছে, ভয়ও বাড়ছে শ্রীলার। হাওয়া কেটে কেটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে জর্জ জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী মনে হয় পক্ষীরাজে চড়স?’’
হাওয়ার ঝাপটায় শ্রীলার নাকে এসে লাগে মিঠেপান-জর্দার গন্ধ। বাড়ির পাশেই ফুটপাতের ওপরেই প্রিয় পানের দোকান। মিঠেপাতার সঙ্গে পরিমাণ-মতো চুন-খয়ের আর জর্দা। পান মুখে না দিলে মেজাজটাই জমে না। সারা ঘরে উড়ে বেড়ায় সেইসব গন্ধেরা।
এই জর্জের ঘরেই ছিল তাঁর ‘দিদিমণি’-র ছবি। বয়সে তাঁর থেকে চোদ্দ বছরে ছোটো সেই মেয়েটি তাঁকে অবলীলায় ‘জর্জ’ বলে সম্বোধন করেন। বিশ্বভারতীর ছাত্রী, কালো পাড়-সাদা শাড়ির সুচিত্রা মিত্রের গানে মুগ্ধ হতেন জর্জ। একসঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে গেয়েওছেন। খুব জ্বর নিয়ে তখন জর্জ রামকৃষ্ণ শিশুমঙ্গল হাসপাতালে ভর্তি। জ্বরের ঘোর থেকে বারবার ছিটকে আসছিল ‘দিদিমণি, দিদিমণি’, কখনও বা ‘সুচিত্রা’। জর্জের অসুখের খবর শুনে ছুটে এসেছিলেন সুচিত্রাও। এই জ্বরের ভিতর থেকে সুচিত্রার এক চিঠির উত্তরে জর্জ লিখেছিলেন, "আজ আপনাকে একটা ভীষণ সত্যি কথা বলছি— কথা হল এই— অসুখের মধ্যে আপনার চিঠিটা ভীষণ ভালো লেগেছে। এবং এত ভীষণ ভালো লেগেছে যে অনেকবার পড়ে ফেলেছি।"
একদিন জর্জের বাসায় এসে ‘‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গান নিয়ে আলোচনা, তর্ক। হারমোনিয়াম টেনে বের করলেন জর্জ। গাইতে শুরু করলেন সুচিত্রা। ‘চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে’র ‘চন্’ অংশটা নিয়ে বিতর্ক। জর্জ বললেন, ‘‘‘চন্’ শব্দডা যে স্বরলিপি অনুসারে হইল না দিদিমণি।’’ পরে শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছিলেন, জর্জের কথাই ঠিক। কিন্তু দূরত্ব বাড়তে লাগল জর্জ আর দিদিমণির ভিতরে। ১৯৬৯-এ বিরাট আঘাত। জর্জের দু-দু’টি গান আটকে দিল বিশ্বভারতীর বোর্ড। রেকর্ড করা বন্ধই করে দিলেন জর্জ! তখন বাজারে তাঁর ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে হুহু করে।
জর্জের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিল্পী খালেদ চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জর্জের সঙ্গে অন্যান্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের রেকর্ড বিক্রির ফারাকটা ছিল বিরাট। সেইটাই নাকি বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডের লোকেরা মেনে নিতে পারেনি। ঈর্ষা জমাট বাঁধছিল। বলেছিলেন, জর্জের পিছনে ‘‘সুবিনয় রায়, সুচিত্রা লেগেছিল, আবার লাগেনি।’’
জর্জ সেই যন্ত্রণায় কাতরেছেন আমৃত্যু। অথচ, তাঁর প্রিয় ‘দিদিমণি’ সুচিত্রা মিত্র আত্মকথায় লিখেছেন, ‘‘জর্জের গান বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড বাতিল করেছিল বলে যা এক সময় বহু জায়গায় প্রচারিত হয়েছে, তা ঠিক নয়। জর্জের কোনও গান বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড খারিজ করেনি।’’ কিন্তু এই কথা জর্জের জীবনে কোনো শান্তি বয়ে আনেনি। বরং শ্বাসের কষ্ট বাড়তেই থাকে। ৭ অগস্ট, মৃত্যুর ১১ দিন আগে শেষ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু বলেছেন আমার হাঁপানি একেবারে সারানো যাবে না— হয়তো আক্রমণটা কিছু কমতে পারে। … এই রকম অকর্মণ্য হ’য়ে থাকার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভাল— কিন্তু আত্মহত্যা করার সাহস আমার নেই!”
আত্মহত্যা করতে হয়নি জর্জকে। সব কষ্ট গুটিয়েই একদিন অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমালেন তিনি। সেদিনও মেঘ, সেদিনও বর্ষা। তাঁর প্রিয় বর্ষা। শোকসভায় তাঁর প্রিয় ‘দিদিমণি’ এসেছিলেন। গেয়েছিলেন - ‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার।’
সেদিনও মেঘ শামিয়ানার মতো টাঙানো ছিল শহরের আকাশে।
ঋণ: দেবব্রত বিশ্বাস- দূরে যাব যবে স’রে তখন চিনিবে মোরে, ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা (শ্যামল চক্রবর্তী), তার ছিঁড়ে গেছে কবে, আবীর মুখোপাধ্যায়