নদীতে ভেসে চলেছে সার দিয়ে মৃতদেহ। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ, বিহার এমনকি বাংলাতেও নজরে এসেছে এই ছবি। এবার প্রকাশ্যে এল আরও ভয়ঙ্কর দৃশ্য। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গণকবর দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। আর এই ছবি দেশের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশেরই। কোভিড মহামারীর মধ্যে ঠিক যেন ভৌতিক গল্পের প্রেক্ষাপট যোগীর রাজ্য।
উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে গঙ্গার দীর্ঘ গতিপথ। আর তার দুই তীরের নরম পলিমাটির মধ্যেই সমাধি দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোভিড আক্রান্তের মৃতদেহ। স্থানীয় ও জাতীয় একাধিক সংবাদমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, সেই সংখ্যাটা ২০০০-এর কম নয়। আর এমন ঘটনা চোখে পড়েছে উত্তরপ্রদেশের মোট ২৭টি জেলায়। তার মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর অবস্থা গাজিয়াবাদ, কানপুর, উন্নাও, গাজীপুর এবং বালিয়াতে।
স্থানীয় একটি হিন্দি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শুধু উন্নাওতেই গত সপ্তাহেই পাওয়া গেছে ৯০০-র বেশি মৃতদেহ। কানপুরে পাওয়া গেছে ৪০০-র বেশি আক্রান্তের দেহ। এমনকি উত্তরপ্রদেশের মধ্যে এবং পূর্ব অঞ্চলেও একই ঘটনা লক্ষ করা যাচ্ছে বলেই দাবি তাদের।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশজুড়ে ভারি বর্ষণের ফলে নদী তীরবর্তী অঞ্চলের মাটি ধুয়ে যাওয়ায় প্রথম নজরে আসে ঘটনাটি। তারপর অনুসন্ধান চালাতেই সামনে আসে ভয়ঙ্কর ছবি। বৃষ্টির কারণে সমাধিস্থ দেহগুলি বাইরে বেরিয়ে আসায়, সেগুলো ঠুকরে খাচ্ছে কাক-চিল। শেয়াল, কুকুরে মুখে করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেসব মৃতদেহ।
আরও পড়ুন
মজবুত করতে হবে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, করোনা-মোকাবিলায় নিদান চিকিৎসকদের
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয় মানুষ। তার জেরেই নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। জানানো হয়েছে গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চল থেকে মৃতদেহগুলি উদ্ধার করে সৎকারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবে কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সে ব্যাপারে এখনও কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি যোগীর সরকার।
আরও পড়ুন
লোহার ফুসফুস নিয়েই ৬৮ বছর, করোনায় সন্ত্রস্ত আলেকজান্ডার
গঙ্গাবক্ষে ভেসে চলা মৃতদেহ নিয়েই প্রথম থেকেই ঘনিয়ে উঠেছিল বিতর্ক। অভিযোগের আঙুল উঠেছিল উত্তরপ্রদেশের সরকারের অব্যবস্থা নিয়ে। তবে সেদিকে কর্ণপাত করেনি যোগীর প্রশাসন। এমনকি কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেছিলেন, মোক্ষলাভের জন্যেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে গঙ্গাবক্ষে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে মৃতদেহ। করোনাকালেই নয়, স্বাভাবিক সময়েও এমন ঘটনা ঘটে বারানসী-সহ একাধিক শহরে। ধর্মবিশ্বাস থেকেই গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় আধপোড়া মৃতদেহ। তবে তার সংখ্যা এত বেশি নয়। আর বর্তমান ঘটনার আসল কারণ যে সেটা নয়, এবার পরিষ্কার সেই ছবি।
আরও পড়ুন
করোনা প্রতিরোধে নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা, নজির গড়ছে হিমাচলের উপজাতি সম্প্রদায়
একাধিক সংবাদ মাধ্যমে স্থানীয়দের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, এই ঘটনার বাড়বাড়ন্ত চিতাকাঠের অভাবেই। মৃতের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী কাঠের যোগান প্রায় অপ্রতুল। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাঠের দাম এবং সৎকার-কর্মের খরচও। ফলে দরিদ্র মানুষের এই পন্থাকেই বেছে নিচ্ছেন বাধ্য হয়ে।
পাশাপাশি উঠে আসছে আরও এক চাঞ্চল্যকর দাবি। অনেকের মতে উত্তরপ্রদেশে পর্যাপ্ত টেস্ট হচ্ছে না করোনার। ফলে চিকিৎসা শুরু হতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ফলত, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে হু-হু করে। সরকারি খাতায় অবশ্য তা নথিভুক্তই নয়। এমন অবস্থায় গোটা ব্যাপারটা অঞ্চলের বাসিন্দাদের থেকে লুকিয়ে রাখতেই, মৃতের পরিবার বেছে নিচ্ছেন এই পথ।
তবে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই গণকবর যে দূষণ ছড়াচ্ছে গোটা অঞ্চলজুড়ে তাতে সন্দেহ নেই কোনো। সেইসঙ্গে দেখা দিচ্ছে অন্য প্রাণীদের মধ্যেও সংক্রমণের আশঙ্কা। যা পরোক্ষভাবে বিপদের মুখে ফেলতে পারে মানুষকেই। এই আশঙ্কা থেকেই ইতিমধ্যে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন সমাজকর্মী ও নদী আন্দোলনকর্মীরা। প্রশাসনের তরফে আশ্বস্ত করে জানানো হয়েছে, গঙ্গাবক্ষে রুটিন চেকিং-এর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তৎপর হতে বলা হয়েছে জলপুলিশকেও। নদী বক্ষে মৃতদেহ ভাসানো যাতে বন্ধ হয়, তার জন্য চলবে কড়া নজরদারি। তবে প্রতিবাদকর্মীদের বক্তব্য, এই পদক্ষেপে যে একদিনেই বদলে যাবে গোটা ছবিটা— এমন নয়। রাজ্যের সম্পূর্ণ পরিকাঠামোকে বদল না করতে পারলে, উন্নতি হবে না অবস্থার। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো খামতি রয়েছে বলে স্বীকার করতে চাইছে না উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন।
সারা দেশেই ভয়াল পরিস্থিতি করোনার। ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে চলেছে মৃত্যুমিছিল। গতকাল সারা দেশে মারা যান ৪ হাজার ৯২ জন মানুষ। যার ফলে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছুঁল ২ লক্ষ ৭৩ হাজারে। কোভিডের প্রথম তরঙ্গের সময়ও এত দীর্ঘ হয়নি মৃত্যুমিছিল। ভেঙে পড়েনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও। সারা দেশে পরিকাঠামোর অভাব আর কোভিড পরিস্থিতিরই কি প্রতীক হয়ে রইল এই ছবি?
Powered by Froala Editor