একজন তরুণ প্রশাসক, দেবদত্তা রায় মাত্র আটত্রিশ বছর বয়েসে কোভিডের শিকার হয়ে অকালে চলে গেলেন। বয়স মাত্র আটত্রিশ! চলে যাওয়ার সময় নয় একদমই, তবু একজন ডব্লিউবিসিএস অফিসার, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেকটর এত অল্প বয়েসে কর্তব্যে অবিচল থেকে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। তুলে দিয়ে গেলেন একাধিক প্রাসঙ্গিক তিতকুটে প্রশ্ন।
কয়েকদিন আগেই আরেক মায়ের আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে শ্বাসকষ্টে ছটফট করা সন্তানকে হাসপাতালে ভর্তি করার সংবাদ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম আমরা সকলেই। করোনা আবহেই প্রতিনিয়তই বাড়ছে এই ধরনের গাফিলতিতে মৃত্যুর খবর। ঠিক যেমন বাড়ছে বিন্দুমাত্র নিয়ম কানুন না মেনে রাস্তাঘাটে মানুষজনের সংখ্যাও। সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত হয়ে হুগলির চন্দননগরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়ের মৃত্যুর পর আরো একবার অনেক প্রশ্ন তুলে দিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল।
গত সোমবার সকালে শ্রীরামপুরের শ্রমজীবী কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দেবদত্তা। সম্প্রতি লকডাউনের সময় যেসব পরিযায়ী শ্রমিক বিভিন্ন রাজ্য থেকে ডানকুনি স্টেশনে নেমে ছিলেন, তাঁদের বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্ব ছিল তাঁরই কাঁধে। দেবদত্তার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে ‘কোভিড যুদ্ধের সামনের সারিতে থাকা সেনানী’ বলে উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাস্তবিকই, কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট উজ্জ্বল এবং কর্মদক্ষ অফিসার হিসেবে পরিচয় ছিল তাঁর। পুরুলিয়া-২ ব্লকের বিডিও থাকার সময় পরিচয় পাওয়া যায় তার বহুমুখী কর্মদক্ষতার। শক্ত হাতে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে জানতেন দেবদত্তা। জীবনের শেষ দিন অবধি সমস্ত দায়িত্ব পালন করে এসেও হেরে গেলেন সেই দায়িত্বেরই ছুড়ে দেওয়া সংক্রমণের ফলে।
দেবদত্তার মৃত্যুর পরেই হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর পাঠানো একটি মেসেজ ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়, যেখানে তিনি লিখেছিলেন কীভাবে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন তাঁর স্বামী এবং তিনি দু’জনেই করোনা আক্রান্ত। দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন সন্তান এবং শ্বাশুড়ির শারীরিক অবস্থা নিয়েও।
আরও পড়ুন
পোলিও নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বাঙালি বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা
সাম্প্রতিক অতীতে বারংবার সংবাদমাধ্যমে রাজ্যের তরফেই জানানো হয়েছে যে দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় যথেষ্ট ভালো এখানকার করোনা পরিস্থিতি। যদিও রাস্তায় বেরোলেই ছবিটা দেখা গিয়েছে সবসময় উল্টো। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না কেউ। থিকথিকে ভিড় বাজারে-দোকানে। গাফিলতি এড়িয়ে যেতে পারে কি সরকারও? অফিস কাছারি শুরু হয়ে যাওয়ার পরেও গণপরিবহনের অভাব দূর হয়নি। যতগুলো সিট, ততজনই যাত্রী বাসে উঠবে বলার পরেও দেখা গিয়েছে সেই বাদুড়ঝোলা বাসের ছবি।
হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ কেউ তো বিরক্ত হয়ে বলেই দিয়েছেন, করোনা ছাড়া আর অন্য কোনও রোগে আক্রান্ত হওয়াও বোধহয় এই সময় অপরাধ! কোনও হাসপাতাল বলছে শুধু করোনা রোগীদেরই ভর্তি নেবে; আবার কোনও হাসপাতাল বলছে করোনা সন্দেহভাজনদের ভর্তি করার কোনও ব্যবস্থাই সেখানে নেই।
আরও পড়ুন
গত তিন মাসে দিল্লিতে করোনা-আক্রান্ত ১২০০০ স্বাস্থ্যকর্মী, চাঞ্চল্যকর তথ্য
স্বাভাবিকভাবেই শারীরিকভাবে ধাক্কা সামনে নেওয়া সম্ভব হলেও, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন রোগী অথবা রোগীর পরিবার। এরকমও প্রশ্ন উঠছে যে, যেখানে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদরই জীবনের কোনও সুরক্ষা নেই, সেখানে সাধারণ মানুষেরা আদতেই কতটা সুরক্ষিত? দেবদত্তার চার বছরের ছেলের পক্ষে বুঝে ওঠাই সম্ভব হচ্ছে না, মা চলে গিয়েছেন চিরদিনের মতো। যেখানে দেবদত্তা হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছেন, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন তিনি, সেখানে হাসপাতাল সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একদমই কমে এসেছিল তাঁর। সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল মারাত্মক হারে।
গলদটা কী রয়ে গেল? আসলে আমাদের তো বোঝানোই হয়, করোনা এমনিতে মারাত্মক কোনো ব্যাধি না; আর বয়স অল্প হলে মৃত্যুর কোনও সম্ভাবনাই নেই। বোঝানো হয়, এই রোগে নাকি শুধু বয়স্কদেরই মৃত্যু হয়! অথচ গত একমাসের বিশ্বজুড়ে পরিসংখ্যান কিন্তু পরিষ্কার জানাচ্ছে অন্য কথা। মোট মৃতের একটি বড় সংখ্যারই বয়স ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। কোনও রকম লক্ষণও পাওয়া য়ায়নি তাঁদের মধ্যে।
আরও পড়ুন
এক সপ্তাহে কন্টেনমেন্ট জোনের সংখ্যা বাড়ল ২৫ শতাংশ, বেহাল অবস্থা রাজ্যে
সমস্যাটা কি তাহলে সেই সবজান্তা মানসিকতারই? সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা যে রোগকে এখনও ধরতে পারছেন না, এদেশে ঠেকের আড্ডায়, চায়ের দোকানে, রকে তার দাওয়াই বের হয়ে যায় রোজ, চলে ‘করোনা মাতা’র পুজো। রাজনৈতিক চাপানুতোর। সেসবেই মাঝেই দেবদত্তার মৃত্যু কি নড়িয়ে দিল না আমাদের প্রথাগত ধারণাকে? সহানুভূতির কোনও অক্ষরই কী বরাদ্দ হতে পারে চার বছরের মা-হারা শিশুটির জন্য?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে পিসিআর যন্ত্র দিচ্ছে পুরুলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়