বছর তিনেক আগের কথা। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ১৪ মার্চ। তারিখটা কিংবদন্তি পদার্থবিদ আইনস্টাইনের জন্মদিনও বটে। ঠিক সেইদিনই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন আইনস্টাইন পরবর্তী সময়ের পদার্থবিদ্যার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব স্টিফেন হকিং (Stephen Hawking)। চার দশকের বেশি সময় ধরে, যাঁর গবেষণা বার বার ভবিষ্যদ্বাণী করেছে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা, মহাজাগতিক রহস্য কিংবা আপেক্ষিকতাবাদে। অথচ, পদার্থবিদ্যার ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিলেও স্টিফেন হকিং ব্রাত্য থেকে গেলেন সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার নোবেল (Nobel Prize) থেকে। তবে আরও বছর খানেক সময় পেলেও হয়তো তাঁর হাতে উঠত নোবেলের পদক।
হ্যাঁ, এমনটাই উঠে আসছে একদল গবেষকের সাম্প্রতিক মন্তব্যে। অন্তত নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন দাবি করছে তেমনটাই। এমনকি শেষ জীবনে নোবেল নিয়ে একাধিকবার আগ্রহও প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং হকিং। তাঁর সেই ইচ্ছেপূরণ হতে পারত ২০১৮-১৯ সালের মধ্যেই। আর তা তিনি পেতেন সত্তরের দশকে তাঁর দেওয়া ব্ল্যাকহোল সংক্রান্ত তত্ত্বের জন্য। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, প্রায় চার দশকেও কেন নোবেল কমিটির মনোনয়ন পেলেন না তিনি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসে। নজর দিতে হবে স্যার অ্যালফ্রেড নোবেলের লিখে যাওয়া উইলের দিকে। সেই উইলের প্রথম শর্তই ছিল কোনো আবিষ্কার ব্যবহারিকভাবে প্রমাণিত হলে, তবেই নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে। সেই জায়গাতেই আটকে যান স্টিফেন হকিং। শুধু হকিং-ই নন, শুধুমাত্র ব্যবহারিক প্রমাণের অভাবে এই একই সমস্যার সম্মুখীন হন তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা। যে কারণে, আইনস্টাইনকেও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় ১৬ বছর।
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্ল্যাকহোলকে মহাজাগতিক পটহোল বললেও ভুল হয় না। সেখান থেকে কোনো পদার্থ এমনকি আলোও নির্গত হতে পারে না, এমনটাই জানিয়েছিলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। কিন্তু ক্রমাগত শোষণের ফলে ভর বাড়তে থেকে ব্ল্যাকহোলের। ঠিক এই জায়গা থেকেই গবেষণা শুরু করেছিলেন হকিং। হকিং প্রথম দেখান ভর বাড়তে বাড়তে একটা সময় ব্ল্যাকহোল নিজেও দ্বিবিভক্ত হয়ে যেতে পারে। দেখান, দুটি কম ভরের ব্ল্যাকহোল নিজেদের মধ্যে জুড়ে গিয়ে তৈরি করতে পারে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। জেমস বার্ডিনের সঙ্গে যৌথভাবে ’৭৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘দ্য ফোর ল’স অফ ব্ল্যাকহোল মেকানিজম’ গবেষণাপত্রটি।
কিন্তু তৎকালীন সময়ে হকিং-এর এই ‘নো হেয়ার’ তত্ত্বের প্রমাণ তো দূরের কথা, ব্ল্যাকহোল ক্যামেরাবন্দি করার মতোও যন্ত্রাংশ ছিল না বিজ্ঞানীদের হাতে। পরবর্তীতে সেই পথটাও দেখিয়েছিলেন হকিং-ই। তিনিই ধারণা দিয়েছিলেন লিগো বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেক্টরের। সেটা ২০০৩ সাল। সে যন্ত্র তৈরি হয়ে কাজ করা শুরু করে ২০১২ সালে।
তারও ৩ বছর পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম লিগো যন্ত্রে ধরা পড়ে দুটি ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষের মহাজাগতিক ঘটনা। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ কিপ থোর্ন। গবেষণাপত্রে সেই আবিষ্কারকে থোর্ন শতাব্দীপ্রাচীন আইনস্টাইনের তত্ত্বের প্রমাণ হিসাবে বর্ণনা করলেও, উল্লেখ করেননি হকিং-এর ব্ল্যাকহোল মেকানিজম তত্ত্বের কথা। গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পাওয়ার আগেই, তার কপি এসে পৌঁছেছিল হকিং-এর কাছে। ডঃ থোর্নকে ব্যক্তিগতভাবে ফোনও করেছিলেন স্টিফেন হকিং। কিন্তু থোর্ন জানিয়েছিলেন, আর কোনো সুযোগই নেই গবেষণাপত্রটিতে বদল আনার।
২০১৭ সালে ক্যালটেকের গবেষক ডঃ গিসলার ২০১৫ সালের ব্ল্যাকহোল সংঘর্ষের ঘটনাটিরই বিশ্লেষণ করেন। জানান, সংঘর্ষরত ব্ল্যাকহোল দুটির ভর ছিল যথাক্রমে সূর্যের ভরের ২৯ গুণ এবং ৩৬ গুণ। সংঘর্ষের পর সংযুক্ত ব্ল্যাকহোলের ভর হয় সূর্যের ভরের প্রায় ৬২ গুণ। আর বাকি শক্তি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল মহাবিশ্বে। যার ধাক্কাই প্রথম ধরা পড়ে লিগো যন্ত্রে। উল্লেখ্য, এই গবেষণাপত্রটিই প্রমাণ করে হকিং-এর তত্ত্বকে। আর এই পত্রের জন্যই ঘনিয়ে এসেছিল তাঁর নোবেলজয়ের সম্ভাবনা। কিন্তু তার কয়েক মাসের মধ্যেই প্রয়াত হন হকিং। আরও মাস পাঁচেক তিনি জীবিত থাকলেই হয়তো নোবেল উঠত তাঁর হাতে। অন্যদিকে অ্যালফ্রেড নোবেলের উইল অনুযায়ী মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার প্রদান করা যায় না। ফলত, শেষ পর্যন্ত নোবেলের সম্ভাব্য মনোনয়ন তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল হকিং-এর নাম। তবে এর পরেও, এই যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী যে তিনিই, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor