প্রয়াত 'ডারউইনের বংশধর' ডঃ এডওয়ার্ড উইলসন

২৭ ডিসেম্বর। জীববিজ্ঞানের ইতিহাসে এই তারিখটি চিরস্মরণীয়ই বটে। ১৮৩১ সালে এই দিনটিতেই ঐতিহাসিক সমুদ্র অভিযানে বেরিয়ে পড়েছিলেন বিবর্তনবাদের জন্মদাতা চার্লস ডারউইন। আর গত পরশুদিন, এই তারিখেই ৯২ বছর বয়সে বিদায় নিলেন ডারউইনের প্রাকৃতিক বংশোধর তথা কিংবদন্তি জীববিজ্ঞানী, প্রকৃতিবিদ ও সংরক্ষণকর্মী ডঃ এডওয়ার্ড উইলসন। এও এক অদ্ভুত সমাপতনই বটে। 

১৯২৯ সালে অ্যালাবামার বার্মিংহামে জন্ম এডওয়ার্ড ওসওয়ার্ল্ড উইলসনের। তারপর ঠিকানা-বদল। বড়ো হয়ে ওঠা পেনসাকোলা শহরে। মাত্র সাত বছর বয়সেই দুর্ঘটনার শিকার হন এডওয়ার্ড। মাছ ধরতে গিয়ে ডানদিকের চোখে গিঁথে যায় বঁড়শি। অস্ত্রোপচার হলেও রক্ষা পাননি এডওয়ার্ড। বাকি জীবনে কাজ চালাতে হয়েছিল এক চোখের দৃষ্টি দিয়েই। আর এই দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলাই যেন শাপে বর হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর বিজ্ঞানচর্চার। 

এক চোখ হারিয়ে ফেলায় তাঁর দৃষ্টিশক্তির মাত্রা নেমে আসে ২০/১০-এ। ফলে, অন্যদের থেকে তিনি আরও ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন আকারে ছোটো কোনো পদার্থকে। ফোকাস করতে পারার সুবিধার জন্যই। আর এই ক্ষমতাই তাঁকে আকৃষ্ট করে তোলে প্রজাপতি, পিঁপড়ের মতো জীবদের যাপনচিত্রের প্রতি। কিশোর বয়স থেকেই বিভিন্ন গোত্রের পিঁপড়ে এবং তাদের জীবনধারণের রীতি নিয়ে ডায়েরি লেখা শুরু করেন এডওয়ার্ড।

এই ব্যক্তিগত অনুসন্ধানই যে কখন বিজ্ঞানচর্চার রূপ নিয়েছিল, তা নিজেও জানতেন না তিনি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ‘ইম্পোর্টেড অ্যান্ট’ প্রজাতির পিঁপড়ের উপনিবেশ আবিষ্কার করে ফেলেন এডওয়ার্ড। জোটে স্বীকৃতিও। পরবর্তী ৮০ বছরে আরও চারশোরও বেশি প্রজাতির পিঁপড়ে আবিষ্কার করেছেন কিংবদন্তি মার্কিন জীববিজ্ঞানী। এন্টিমোলজি এবং মিরমেকোলজি অর্থাৎ পিপীলিকাবিদ্যার দুনিয়ায় আজও একটি স্তম্ভ তিনি। অমূল্য সম্পদ তাঁর লেখা গ্রন্থগুলি। এই বিশেষ বিষয়ে বিস্তারিত কাজের জন্য ‘অ্যান্ট-ম্যান’ হিসাবেও বিজ্ঞানীমহলে জনপ্রিয় এডওয়ার্ড উইলসন। 

তবে এখানেই শেষ নয়। পিঁপড়েবিদ্যার বাইরেও তাঁর বিস্তারিত কাজ রয়েছে জেনেটিক সত্তা নিয়েও। মানুষের আচার-আচরণ এবং বিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে জিনগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত, তা ফুটে ওঠে এডওয়ার্ডের গবেষণায়। এডওয়ার্ড তাত্ত্বিকভাবে দেখান, পৃথিবীর চিরাচরিত পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে ধ্বংস করাই যেন ভবিতব্য মানব সভ্যতার। তা প্রথিত রয়েছে মানুষের জিনেই। এমনকি হিংস্রতাও। ‘সোসিওবায়োলজি: দ্য নিউ সিন্থেসিস’ গ্রন্থে বিষয়টি সবিস্তারে আলোচনা করেছেন এডওয়ার্ড। বিবর্তন এবং বাস্তুতন্ত্রের জগতে এই গ্রন্থ একটি মাইলফলকই বটে। এই গ্রন্থরচনার জন্য ‘ডারউইনের প্রাকৃতিক বংশোধর’-এর তকমাও পান তিনি। পেয়েছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার। তবে বিতর্কও কম হয়নি এই বই নিয়ে। বর্ণবাদ এবং যৌনতাবাদের অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। 

বাস্তুতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসাবেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অরণ্যনিধনের প্রতিবাদে বার বার সরব হয়েছেন এডওয়ার্ড। সামিল হয়েছেন জলাভূমি বাঁচানোর লড়াইতেও। তাঁর কাব্যিক বক্তৃতা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমাজের সকল স্তরের মানুষদের। ‘অর্থের জন্য অরণ্যনিধন এবং রেনেসাঁর কোনো চিত্রকর্মকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা সমার্থক’, রাষ্ট্রপুঞ্জে এমনই বলিষ্ঠ দাবি করেছিলেন ‘ডারউইন’স হেয়ার’। জানিয়েছিলেন, আবিষ্কারের আগেই বাস্তুতন্ত্রের অজানা প্রজাতিদের হারিয়ে যেতে দেওয়া মানব সভ্যতার সমীচীন নয়। তাঁর মতানুযায়ী, পৃথিবীর কেবলমাত্র ১০ শতাংশ প্রজাতির অনুসন্ধান করতে পেরেছে মানুষ। বাকিটা এখনও অজানা। পরিবেশ সংরক্ষণে তিনি নিজেই তৈরি করে ফেলেছিলেন আস্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ই ও উইলসন বায়োডায়ভার্সিটি ফাউন্ডেশন’। 

দীর্ঘ কয়েক দশক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন এডওয়ার্ড। অবসরের পরও জড়িয়ে ছিলেন গবেষণায়। সেইসঙ্গে, উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের এক ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করার। উইলসন এনসাইক্লোপিডিয়া অফ লাইফ। অনলাইন এই ডেটাবেসে তিনি নিজে হাতেই লিপিবদ্ধ করেছেন ১৯ লক্ষ প্রজাতির প্রাণীর বিবরণ। বিনামূল্যে যাতে এই সাইট দেখার সুযোগ পান সাধারণ মানুষ, সেই বন্দোবস্তও করে রেখে গেছেন তিনি। 

জীবদ্দশায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য একাধিক পুরস্কার তো পেয়েছেনই, সেইসঙ্গে সাহিত্যরচনার জন্যও দু’-দু’বার পুরস্কৃত হয়েছেন পুলিৎজারে। এমন একজন বৈচিত্রময়, মানুষের চলে যাওয়া যেন আরও খানিকটা অভিভাবকহীন করে তুলল পৃথিবী তথা প্রকৃতিকে…

Powered by Froala Editor