বছর খানেক আগের কথা। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বিমানের ডানায় চেপে মেঘের রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়ে এক আশ্চর্য নজির গড়েছিলেন ৯৩ বছরের ব্রিটিশ প্রবীণা বেট্টি ব্রোমাজ। বেট্টির এই কৃতিত্ব সে-সময় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে এমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ভাগীদার বেট্টিই প্রথম নন। বরং, রাইট ব্রাদার্সের (Right Brothers) প্রথম সফল উড়ানের দু’দশক পর থেকেই চালু হয়েছিল এই আশ্চর্য ফ্লাইং স্টান্ট। অল্পসময়ের মধ্যে যা জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিল পাশ্চাত্যে।
‘ডেয়ারডেভিল উইং ওয়াকিং’ (Daredevil Wing Walking)। হ্যাঁ, এই নামেই পরিচিত এই বিশেষ স্টান্ট। কিন্তু চরম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে ইউরোপীয় সংস্কৃতির মূলস্রোতে ঢুকে পড়ল এমন একটা ‘খেলা’?
খেলাই বটে। একটা সময় পর্যন্ত এই স্টান্টকে ‘অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস’ হিসাবেই মনে করতেন ইউরোপের বহু মানুষ। ১৯০৩ সাল। বিশ্বের সর্বপ্রথম যন্ত্রচালিত বিমান উড়িয়ে ইতিহাস গড়েন রাইট ভাতৃদ্বয়। পরবর্তী এক দশকে ইউরোপে পরীক্ষামূলকভাবে বিমান ব্যবহৃত হলেও, ব্যাপক হারে তার ব্যবহার শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। এমনকি এইসময়ে গণহারে বহু সৈনিককেই দেওয়া হয়েছিল বিমান চালনার প্রশিক্ষণ। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, মূলত এই বিমানচালকদের হাত ধরেই সূত্রপাত হয়েছিল ‘ডেয়ারডেভিল উইং ওয়াকিং’-এর।
আসলে বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে পদে পদে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকলেও, তাতে অ্যাডভেঞ্চার কম ছিল না। আর সেই অ্যাডভেঞ্চারের নেশাতেই পাশ্চাত্যের বিমানচালকরা নানারকম খেলা দেখাতে শুরু করেন জনসাধারণকে। কখনও কৌতূহলী দর্শকদের বিমানে চাপিয়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে নিতে যেতেন তাঁরা। কখনও আবার খামার-মালিকদের অনুরোধে খামারের মাঝে অস্থায়ী এবং অসমতল রানওয়ে তৈরি করে অবতরণ করতেন বিমান। ‘বার্নস্টর্মার্স’ নামে পরিচিত ছিল এই খেলা। তবে এসব স্টান্ট খুব বেশিদিন জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি। ফলে শুরু হয়েছিল নতুনত্বের সন্ধান।
সেই সূত্রেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘উইং ওয়াকিং’ উদ্ভাবন করেন ২৬ বছর বয়সি মার্কিন এয়ার সার্ভিসের পাইলট ওর্মার লকলেয়ার। বিমান চালাতে চালাতে, উড়ন্ত বিমানের ককপিট থেকে মাঝেমাঝেই বাইরে বেরিয়ে আসতেন ওর্মার। বিমানের পশ্চাৎভাগের ওপর দাঁড়িয়ে বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করার পর আবার প্রবেশ করতেন ককপিটে। তাঁর এই কার্যকলাপ রীতিমতো প্রশংসাও পায় কমান্ডিং অফিসারদের থেকে। ওর্মারের এই স্টান্ট দেখতে রীতিমতো ভিড় জমাতেন অন্যান্য পাইলটরাও।
সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর ওর্মার হয়ে ওঠেন পেশাদার স্টান্টম্যান। আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে আয়োজিত মেলায় ঘুরে ঘুরে খেলা দেখাতেন তিনি। হিসেব বলছে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে তাঁর দৈনিক উপার্জন ছিল প্রায় ৩ হাজার মার্কিন ডলার। প্রাথমিকভাবে বার্নস্টর্মিং দিয়ে শুরু করলেও, কিছুদিন পর থেকেই অদ্ভুত সব খেলা দেখাতে শুরু করেন ওর্মার। যার অন্যতম একটি খেলা ছিল ‘স্পিড ম্যাচিং’। বিশ্বের প্রথম মানুষ হিসাবে দ্রুতগামী গাড়ি থেকে দড়ির মই বেয়ে উড়ন্ত বিমানে উঠেও নজির গড়েছিলেন তিনি। তাছাড়াও পাশাপাশি উড়তে থাকা দুটি বিমানের মধ্যে একটি থেকে ঝাঁপ দিয়ে অন্যটিতে পৌঁছাতেন তিনি। ‘ডান্স অফ ডেথ’ নামে পরিচিত ছিল এই খেলা।
পরবর্তীতে ‘ডান্স অফ ডেথ’-এর পরিমার্জিত সংস্করণ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘উইং ওয়াকিং’। এক্ষেত্রে একাই একটি বিমান ওড়াতেন ওর্মার। মাঝ-আকাশে ককপিট থেকে বেরিয়ে তিনি হেঁটে বেড়াতেন বিমানের ডানার ওপরে। তারপর আবার প্রবেশ করতেন ককপিটে। ওর্মারের সে-সময় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর ঝুঁকিকে প্রতিদিন সামনে থেকে পরখ করতে চান তিনি। আর সেই কারণেই নাকি কঠিন থেকে কঠিনতর করে তোলেন নিজের স্টান্টকে।
এই চ্যালেঞ্জই শেষ পর্যন্ত প্রাণ কাড়ে ওর্মারের। ১৯২০ সালে ‘দ্য স্কাইওয়েম্যান’ চলচ্চিত্রের শ্যুটিং-এর সময়ই স্টান্ট দেখাতে গিয়ে বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ওর্মার লকলেয়ার। মাটিতে খসে পড়ে তাঁর ‘কার্টিস জেএন-৪’ বিমান। তৎক্ষণাৎ প্রাণ না-হারালেও অগিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর।
অবশ্য এই দুর্ঘটনার পরেও থেমে যায়নি উইং ওয়াকিং। ততদিনে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই এই স্টান্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্বজুড়ে। ফলে ওর্মারের ফাঁকা স্থান ভরাট করতে এগিয়ে আসেন সেনাবাহিনীর বহু পাইলট। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চার্লস লিন্ডবার্গ। তাছাড়াও এই খেলা দেখানোয় সামিল হন বেসি কোলম্যান, লিলিয়ান বয়ারের মতো বহু আফ্রো-আমেরিকান মহিলাও। উইং ওয়াকিং-কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে বিমানের ডানার ওপর নাচ, ব্যাডমিন্টন খেলার মতো স্টান্টও শুরু করেন তাঁরা। কেউ আবার উড়ন্ত বিমান থেকে ঝাঁপ দিতেন প্যারাসুট নিয়ে।
আজকের দিনে প্যারাট্রুপিং অতি-সাধারণ ব্যাপার হলেও, সে-যুগে উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াও লোকসমক্ষে এই স্টান্ট দেখানো ছিল যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। দুর্ঘটনাও ঘটত কখনও কখনও। ১৯৩৬ সালে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই উইং ওয়াকিং-এ ইতি টানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আইন প্রণয়ন করে ১৫০০ ফুট উচ্চতার নিচে উড্ডয়মান বিমানে দেখানো যাবে না এই স্টান্ট। সেইসঙ্গে বাধ্যতামূলক করা হয় প্যারাস্যুটের ব্যবহার। এদিকে এই উচ্চতার উপরে ওড়া বিমানে মানব-স্টান্ট সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। ফলে সবমিলিয়ে ইতি পড়ে এই আশ্চর্য খেলায়।
পরবর্তীতে উন্নত প্রযুক্তি, সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং বীমা চালু হওয়ায় ১৯৭০-এর দশকে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে উইং ওয়াকিং। তবে নিয়ম বদলে যায় অনেকটাই। আইন পাশ করে জানানো হয়েছিল, বিমানচালকের ভূমিকায় থাকাকালীন উইং ওয়াকিং করা যাবে না। অর্থাৎ উইং ওয়াকিং করতে গেলে বসতে হবে যাত্রীর আসনে। পাশাপাশি বিমানের ডানার সঙ্গে দড়ি ও লক দিয়ে শক্ত করে নিজেকে বেঁধে রাখতে হবে উইং ওয়াকারদের। এই নতুন নিয়ম চালু হওয়ার পর এই স্টান্টে দেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেনি আর। এমনকি ১৫০০ ফুটের ওপরে বিমান উড়লেও প্রযুক্তি ও ক্যামেরার দৌলতে তাঁদের সেই স্টান্ট আজ দেখতে পারেন সাধারণ মানুষ। সবমিলিয়ে ফের ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই খেলা। বিশ্বজুড়ে এই স্টান্ট দেখাচ্ছেন বিভিন্ন পেশাদার উইং ওয়াকার। পাশাপাশি অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বেট্টির মতো সাধারণ মানুষও বিমানের ডানায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মেঘের রাজ্য।
Powered by Froala Editor