পিঠে ঝোলানো রুকস্যাক, টেন্ট। মাথায় সাহেবি হ্যাট। পাথুরে শুষ্ক উপত্যকার হেঁটে চলেছেন এক প্রৌঢ় ব্যক্তি। অভিযানের মাদকতার ছাপ তাঁর চোখে-মুখে। দক্ষ ট্রেকার কিংবা সম্ভ্রান্ত পর্যটক বলেই মনে হবে তাঁকে। তবে ব্যাপারটা একেবারেই তেমনটা নয়। ওই ব্যক্তির পকেটে কানাকড়িও নেই (No Money)। নেই কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও। আক্ষরিক অর্থে যাকে বলা যেতে পারে ‘অর্থহীন’!
হ্যাঁ, এমনই এক আশ্চর্য মানুষ ড্যানিয়েল শেলাবার্গার (Daniel Suelo Shellabarger)। কলোরাডোর (Colorado) ডেনভারের (Denver) এই ৫৯ বছর বয়সী বাসিন্দা বিগত ২১ বছর ধরেই অর্থশূন্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত। নেই কোনো প্রথাগত বাসস্থানও। ডেনভারের পাহাড়ি উপত্যকায় মাথা গোঁজার মতো কয়েকটি গুহা খুঁজে নিয়েছেন ড্যানিয়েল। তবে সেখানেও যে বছরের ৩৬৫ দিন কাটে, তেমন নয়। বরং, গোটা উপত্যকাটাই তাঁর বাড়ি। ইচ্ছে জাগলে খোলা আকাশের নিচেই তাঁবু খাঁটিয়ে রাত্রিযাপন করেন ড্যানিয়েল।
তবে ‘যাযাবর’ জীবনে অভ্যস্ত হলেও, ড্যানিয়েল কিন্তু নোম্যাড নন। বরং, আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই ছিল তাঁর দৈনিক যাপনচিত্র। বিশ শতাব্দীর শুরুর দিক সেটা। তখনও ড্যানিয়েল সেফের ভূমিকায় কর্মরত ইউটা প্রদেশের একটি প্রথম সারির রেস্তোরাঁয়। ড্যানিয়েলকে ভাবিয়ে তুলেছিল মানুষের জীবনে অর্থের ভূমিকা। অর্থাগম যেন আমাদের চাহিদাকে ক্রমাগত বাড়াতে থাকে। অর্থই বিভাজন, বৈষম্য তৈরি করে দেয় সমাজের মধ্যে। ড্যানিয়েল সিদ্ধান্ত নেন জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেবেন সম্পদ, অর্থের এই অধ্যায়। আর তেমনটা করেও দেখান তিনি। কাজ, ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর চলে আসেন এই পাহাড়ি উপত্যকায়। আসার আগে বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সঞ্চয়। যাওয়ার খরচের জন্য যেটুকু অর্থ জমিয়ে রেখেছিলেন, তার থেকে বেঁচেছিল মাত্র ৩০ ডলার। সেটিও কলোরাডোর একটি টেলিফোন বুথে রেখে ‘যাযাবর’ জীবনে পা দেন তিনি। সেই ফোনবুথেই ফেলে আসেন তাঁর পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সও।
প্রশ্ন থেকে যায়, তবে অর্থ ছাড়া কীভাবে এতগুলো বছর টিকে রইলেন তিনি? খাওয়া-দাওয়ার জন্যও তো ন্যূনতম অর্থের প্রয়োজন! না, ড্যানিয়েল আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছেন প্রকৃতির সন্তান। বুনো ব্লুবেরি, আলু, পেঁয়াজ— এসব দিয়েই পেট চলে তাঁর। পানীয় বলতে নদীর জল। খাবার জোগায় নিকটবর্তী জনপদের ডাম্পস্টারগুলিও। ‘সভ্য’ মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার কুড়িয়ে নিয়ে আসেন ড্যানিয়েল। খাদ্য নষ্ট করা তাঁর কাছে ভয়ংকর অপরাধ। ড্যানিয়েলের পোশাক কিংবা অন্যান্য সামগ্রীরও চাহিদা মেটায় শহরের ডাস্টবিনই। কখনো সেখান থেকেই তিনি কুড়িয়ে আনেন মানুষের ফেলে দেওয়া পোশাক, ভাঙা সাইকেল, বিছানা, জুতো— সবকিছুই।
আরও পড়ুন
বিশ্বের অর্থনীতি বদলে দিতে পারে সাইকিডেলিক মাশরুম!
তবে সভ্যতার সঙ্গে তাঁর একেবারেই যোগ নেই বললে ভুল হবে খানিক। তাঁর নিকটজন ডেনভারের ছোট্ট সম্প্রদায় আরভাদায়ের মানুষরা। মাঝেমধ্যেই তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যান তিনি। বই পড়তে হাজির হন স্থানীয় লাইব্রেরিতেও। লাইব্রেরির কম্পিউটার থেকেই লেখেন ব্লগও। তবে অর্থ সাহায্য নৈব নৈব চ।
আরও পড়ুন
অর্থসংকটে পিঙ্ক ফ্লয়েড, ব্যান্ডের ওয়ার্ল্ড ট্যুরের জন্য প্রিয় ফেরারি বেচলেন ম্যাসন
২০১২ সালে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রকাশক। অনুরোধ ছিল আত্মজীবনী লিখতে হবে ড্যানিয়েলকে। তবে ড্যানিয়েলের শর্ত ছিল বই প্রকাশিত হলে তা সমস্ত পাঠককে দিতে হবে বিনামূল্যে। বলাই বাহুল্য, সেই শর্তে রাজি হয়নি কেউই। শেষ পর্যন্ত, তাঁর এক শৈশবের বন্ধু বেশ কাঠখড় পুড়িয়েই রাজি করান তাঁকে। পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয় ‘দ্য ম্যান হু কুইট মানি’। না, এক পয়সাও পারিশ্রমিক কিংবা সাম্মানিক নেননি ড্যানিয়েল। বরং, তিনি পেঙ্গুইনকে বাধ্য করান কয়েকশো বই বিনামূল্যে পাঠকদের হাতে তুলে দিতে।
আরও পড়ুন
‘আমাদের অর্থ নেই, অস্ত্র নেই, আছে শুধু ফুটবল’, বিপ্লবী মারাদোনা ও এক প্রতিশোধের গল্প
ড্যানিয়েলের বিস্ময়কর জীবনের গল্প এখানেই শেষ হতে পারত। তবে আরেকটি জিনিস না উল্লেখ করলেই নয়। ড্যানিয়েল শেলাবার্গারের আত্মজীবনীটি কিন্তু প্রকাশিত হয়েছিল ড্যানিয়েল সুয়েলো নামে। হ্যাঁ, ‘সন্ন্যাস’ জীবনে পা দেওয়ার পর, নিজের পদবি বদলে অলিখিতভাবে ‘সুয়েলো’ হয়েছেন তিনি। কথাটি স্প্যানিশ। তার মানে কী জানেন? মাটি। হ্যাঁ, চমকে উঠতে হয় রীতিমতো। রামকৃষ্ণ ঠিক এমনটাই যে বলে গিয়েছিলেন। ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’…
Powered by Froala Editor