দই-চিঁড়ে উৎসব শুরু করেছিলেন নিত্যানন্দ, ‘হাজির’ চৈতন্যও, তাঁরাও বাংলাদেশি?

ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। বাংলায় তখন এক নতুন ‘বিপ্লব’। গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের গণ্ডি পেরিয়ে, বৈষ্ণবধর্ম পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের ঘরে-ঘরে। চৈতন্য ততদিনে নীলাচলবাসী। নিত্যানন্দকে আদেশ দিয়েছেন বাংলায় ফিরে যেতে, হরিনাম প্রচার করতে। নিত্যানন্দ থিতু হলেন খড়দহে। পানিহাটিতে তখন রাঘব পণ্ডিতের বসবাস। রাঘব পণ্ডিতের সেই আখড়ায় আগেও এসেছেন চৈতন্য-নিত্যানন্দ। এবার, রঘুনাথ দাস গোস্বামী এসে হাজির হলেন পানিহাটিতে। শরণ নিলেন নিত্যানন্দের। কে এই রঘুনাথ দাস?

তিনি ছিলেন সপ্তগ্রামের জমিদার গোবর্ধন দাসের একমাত্র সন্তান। বড়ো হয়েছেন বৈভব ও ঐশ্বর্যের মধ্যে। তবে অল্পবয়সেই চৈতন্যের সাক্ষাৎলাভ করেন তিনি। হয়ে ওঠেন ভক্ত বৈষ্ণব। পরবর্তীকালে, পানিহাটিতে রাঘব পণ্ডিতের কীর্তন-মহোৎসব দর্শন করতে এসে, সাক্ষাৎ পান নিত্যানন্দের। গঙ্গার ধারে, এক বটগাছের নিচে বসে ছিলেন নিত্যানন্দ।

নিত্যানন্দ রঘুনাথের সাক্ষাৎমাত্র বলেছিলেন - ‘আয়, তোকে আজ দণ্ড দিব।’ কী ছিল সেই দণ্ড? নিত্যানন্দ আদেশ দিলেন, উপস্থিত সব ভক্ত বৈষ্ণবকে দই-চিঁড়ে ভোজন করাতে। তারপর? কীভাবে সম্পন্ন হল সেই আয়োজন?

“বড় বড় মৃৎকুণ্ডিকার মধ্যে পাঁচ-সাতজন ব্রাহ্মণ চিঁড়া ভিজাতে লাগলেন। একজন ভক্ত শ্রীনিত্যানন্দ ও ও শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্য চিঁড়া ভিজাতে লাগলেন। অর্ধেক চিঁড়া দই কলা দিয়ে, আর অর্ধেক ঘন দুধ, চিনি, চাঁপাকলা দিয়ে মাখতে লাগলেন।”

চৈতন্য তখন নীলাচলে। জনশ্রুতি, নিত্যানন্দ নাকি ধ্যানের মাধ্যমে চৈতন্যকে ডাক পাঠিয়েছিলেন। আর চৈতন্য হাজির হন সেই দই-চিঁড়ের মহোৎসবে। এ-সম্পর্কে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্যচরিতামৃতে লিখেছেন – ‘মহাপ্রভু আইল দেখি নিতাই উঠিলা। / তাঁরে লঞা সবার চিড়া দেখিতে লাগিলা।।’

সেই থেকে পানিহাটিতে দই-চিঁড়ে উৎসব বা ‘দণ্ড মহোৎসবে’র সূচনা। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লা-ত্রয়োদশী তিথিতে সেই বটগাছের নিচে পালিত হয় দণ্ড মহোৎসব। সারা বাংলা থেকে জড়ো হন হাজার হাজার বৈষ্ণব ভক্ত। নিত্যানন্দ আর চৈতন্যের স্মৃতিমাখা এই উৎসব আক্ষরিক অর্থেই বাংলার এক ‘পরব’ যেন।

কিন্তু হঠাৎ এই ইতিহাসের অবতারণা কেন? সম্প্রতি ভারতের শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ও পশ্চিমবঙ্গ সর্বভারতীয় দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা মন্তব্য করেছেন, কয়েকজন রাজমিস্ত্রিকে চিঁড়ে খেতে দেখেই তিনি বুঝে গেছেন, তারা নাকি ‘বাংলাদেশি’ এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। নেতার কথা শুনে মনে হয়, বাংলাদেশি মানেই বাঙালি। পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে বসবাসকারী অসংখ্য বাঙালির কথা সম্ভবত ভুলেই গেছেন তিনি। কেউ চিঁড়ে খেলেই তাকে 'বাংলাদেশি' হতে হবে? তার ওপর, ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করার সময়, তাঁর ইঙ্গিত ছিল একটি নির্দিষ্ট ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিই। অথচ ভারতের অন্যান্য অনেক জাতিই চিঁড়ে খেতে অভ্যস্ত।

সেই নেতা জানেন না, প্রায় পাঁচশো বছর আগে এক বাঙালি দই-চিঁড়ে খাওয়াকে কেন্দ্র করে গোটা একটা উৎসবের সূচনা করেছিলেন। এবং তা আজও চলছে। তাহলে কি নেতার কথা অনুযায়ী, চৈতন্য-নিত্যানন্দও ‘বাংলাদেশি?’ বাঙালির চিরন্তন একটি খাদ্যাভ্যাসকে এমন সরলীকরণ করা আসলে অজ্ঞানতারই পরিচয়। তাই নয় কি?

(ঋণ - শ্রীশ্রীগৌর-পার্ষদ চরিতাবলী, হরিকৃপা দাস)