১৯৪২ সাল। বোম্বের কংগ্রেস অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী ডাক দিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের। তাঁর আহ্বানে অহিংস আন্দোলনের পথে নামলেন ভারতের কোটি কোটি মানুষ। স্বাধীনতা আনার স্বপ্নে সেদিন দমন থেকে বোম্বে পালিয়ে এসেছিলেন এক ১২ বছরের কিশোরীও। প্রভাবেন শাহ (Pravaben Shah)। যোগ দিয়েছিলেন বারদৌলি স্বরাজ আশ্রমে। জড়িয়ে পড়েছিলেন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। প্রায় দীর্ঘ এক বছর লড়াই করেছিলেন তিনি। আশ্রমের মাটিতেই ঘুমিয়েছেন পাটের বস্তার ওপর। চরকায় বুনেছেন খাদির পোশাক। আট দশক পেরিয়ে এসে এবার ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’-তে ভূষিত হলেন তিনি।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও থেমে থাকেনি তাঁর লড়াই। স্বাধীনতার পর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ক্ষমতায়ন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ সংগ্রহের মতো কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন ভারতের অন্যতম এক সমাজকর্মী। যে কার্যক্রম তিনি স্বমহিমায় চালিয়ে যাচ্ছেন জীবনসায়হ্নে এসেও।
‘বি দ্য চেঞ্জ ইউ ওয়ান্ট টু সি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’— গান্ধীজির এই উক্তিই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। পরিবর্তন চাইলে, নিজেকেই পরিবর্তন আনতে হবে। গান্ধীজির মৃত্যুর পর সেই লক্ষেই পথে নেমেছিলেন প্রভাবেন। স্বল্প বয়সেই বিবাহ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তারপর স্বামীর কর্মসূত্রে চলে আসা গুজরাটের বারদৌলিতে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় সেটা। বারদৌলি এসে প্রভাবেন দেখলেন, কোনো বিদ্যালয়ই নেই আস্ত গ্রামটিতে। একক প্রচেষ্টাতেই পাড়ার কচিকাচা এবং নিজের সন্তানকে তৈরি করে ফেললেন আস্ত একটি স্কুল। শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে অষ্টম শ্রেণি পাশ। কিন্তু হার মানলেন না তিনি। নিজেই শুরু করলেন প্রাথমিক শিক্ষাদান। আর উঁচু ক্লাসের শিক্ষার্থীদের জন্য? হ্যাঁ, তাদের জন্য আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল শিক্ষক নিয়োগ। গান্ধীজির আদর্শই সমাধান খুঁজে দিল। চরকায় খাদির পোশাক বোনা শুরু করলেন প্রভাবেন। সেই কাপড় বিক্রি করেই শিক্ষকদের মাইনের খরচ চালাতেন তিনি।
ষাটের দশকে ফের ঠিকানা বদল। এবার সপরিবারে দমনে যেতে হল তাঁকে। সেখানেও একই ভঙ্গিতে একটি স্কুল স্থাপন করলেন প্রভাবেন। সেই স্কুল চলত ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় নজর কাড়ল তাঁর। আর তা হল মহিলাদের দুর্দশা। তখনও পর্যন্ত দমনে প্রচলিত রয়েছে পর্দাপ্রথা। স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকারও নেই মহিলাদের। তাদের শিকলমুক্ত করতেই আরও এক উদ্যোগ নিলেন তিনি। তৈরি করলেন ‘দমন মহিলা সমিতি’। যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল মহিলাদের স্বাবলম্বী করে তোলা। সেইসঙ্গে তাদের শিক্ষাপ্রদানেরও বিশেষ বন্দোবস্ত করে ফেললেন প্রভাবেন। দিনের বেলায় যে স্কুলে বাচ্চাদের ক্লাস চলত, সেখানেই সন্ধে নামলে গ্রামের মহিলাদের জড়ো করতেন তিনি। শুরু হত পাঠদান। নিজেই সেই কাজটা চালিয়ে গেছেন কয়েক দশক।
আরও পড়ুন
দেশের দ্বিতীয় রূপান্তরকামী হিসাবে পদ্মশ্রী পেলেন কর্ণাটকের যোগাপ্পা নৃত্যশিল্পী
১৯৬৫ কিংবা ’৭১-এর যুদ্ধের সময় সৈনিকদের জন্য বস্ত্র এবং সোয়েটার বুনে সীমান্তে পাঠিয়েছেন প্রভাবেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছেন সাধারণ মানুষের। ১৯৯০ সালে স্বঘোষিত শিক্ষিকার পদ থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু আজও তাঁর নেতৃত্বেই অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছে ‘দমন মহিলা সমিতি’। এবার বিগত আট দশকের এই সংগ্রামেরই যেন প্রতিদান পেলেন প্রভাবেন। পদ্মশ্রীর দৌলতে গোটা ভারতের সামনে এল তাঁর এই লড়াকু মেজাজ এবং সংগ্রামী পরিচয়। তাঁর জীবনদর্শন তরুণ প্রজন্মের হাজার হাজার মহিলা এবং সাধারণ মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
আরও পড়ুন
কবর থেকে ফিরে এসে পদ্মশ্রী, গুলাবু সাপেরার কাহিনি হার মানায় সিনেমাকেও
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
৩০ বছর ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিনামূল্যে চিকিৎসা, পদ্মশ্রী পেলেন ডাঃ কৃষ্ণমোহন পাথি