দিনটা ছিল ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর। উপচে ওঠা ভিড় পার্থের ডাউনটাইন কর্নারের একটি বারে। হবে না-ই বা কেন? শহরে যে সিরিজ চলছে প্রোটিয়া বাহিনীর সঙ্গে ক্যাঙ্গারু ব্রিগেডের। ফলে, দৈনিক ক্রেতাদের পাশাপাশি ভিড় জমিয়েছেন শহরে আগত ক্রিকেটপ্রেমীরাও। আর তার জেরেই গমগম করছে ডাউনটাউন কর্নারের বার কাম রেস্তোরাঁ। তবে এই কোলাহলের মধ্যেও বারের এক কোণায় শান্ত হয়ে বসে রয়েছেন দীর্ঘদেহী এক পুরুষ। স্লিং-ব্যাগে বাঁধা তাঁর ডান হাতটি ঝুলে রয়েছে বুকের কাছে। দু’চোখে অনিশ্চয়তার দোলাচল।
অস্ট্রেলিয়ান বারে একান্ত বসে থাকা সেদিনের সেই দীর্ঘদেহী পুরুষটি ছিলেন স্বয়ং ডেল স্টেইন। তাঁর মতো বিখ্যাত তারকাকে চিনতে ভুল হয়নি কারোরই। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই ভয়ঙ্কর চোটে ভেঙে গেছে তাঁর হাড়। ছিঁড়েছে বুক, হাত এবং পিঠের পেশি। তারপরেও কি কেউ এভাবে হাজির হতে পারে জনসমক্ষে? না, বারে উপস্থিত ব্যক্তিরা কেউ-ই বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি এ-কথা। শেষে দুই আফ্রিকান সাংবাদিক এগিয়ে এসে সেই ভুল ভেঙেছিলেন।
যাঁর ভয়ঙ্কর গতি ত্রস্ত করে রাখত বিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে, সেই ‘স্টেইন-গান’-ই ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন এতটাই সৌম্য-শান্ত, এতটাই সাধারণ। তবে খেলার মাঠেই আগ্রাসী মেজাজের আড়ালে লুকিয়ে পড়ত তাঁর সহজ-সরল নির্মেদ হাসির ঝিলিক। স্টেইন চিরকালই এমন স্পষ্ট বিভাজনরেখা টেনে রেখেছিলেন ব্যক্তিগত আর পেশাগত জীবনের মধ্যে। কিন্তু একের পর এক চোটাঘাত, সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা যেন ক্রমেই ভেঙে দিচ্ছিল সেই বিভেদপ্রাচীর। শেষ পর্যন্ত তাই সকলরকম ফর্ম্যাটের ক্রিকেট থেকেই বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন প্রোটিয়া তারকা।
তবে বিগত এক দশকের বিশ্বের সবথেকে ঘাতক ফাস্ট বোলারের ক্রিকেট কেরিয়ারের শুরুটা হয়েছিল বেশ মন্থর গতিতেই। বরং, তিনি যে বিশ্বের এক নম্বর পেস-তারকা হয়ে উঠবেন, তা স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁর ছোটবেলার কোচ। ছিল আগ্রাসন, স্যুইং-এর দুর্দান্ত দক্ষতা থাকলেও, শুরুতে তাঁর বোলিং-এ গতি ছিল বেশ ধীর। তাঁর শৈশবের কোচের বড়ো বেশি ‘প্রেডিক্টেবল’ ছিলেন স্টেইন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ গতি বেড়েছে তাঁর। ‘প্রেডিক্টেবল’ তকমা কাটিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম বোলার। যাঁর সর্বোচ্চ গতি কখনো ছুঁয়েছে ১৫৬ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টাও। গ্র্যান্ট ইলিয়টের ভাষায়, ‘স্টেন ক্রিকেটকে বেছে নেননি, বরং ক্রিকেটই বেছে নিয়েছিল স্টেইনকে।’
আরও পড়ুন
চাকরি নেই, ইঁটভাটায় দিনমজুরি করছেন ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার!
দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, বরং ২০০৪ সালে পেশাদার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক হয়েছিল আফ্রিকা একাদশের হয়ে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটের তিন ম্যাচের সেই সিরিজে মাত্র ২টি উইকেট সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন স্টেইন। এক কথায় ব্যর্থ বললেই চলে। অন্তত দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড এই পারফর্মেন্সের নিরিখেই সম্ভাব্য তালিকা থেকে সরিয়ে রেখেছিল তাঁর নাম। তবে হতাশ হননি স্টেইন। বদলে তাঁর উইকেট-খিদে বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর সাফল্যের নিরিখে ওই বছরের শেষেই জাতীয় টেস্ট দলে জায়গা করে নেন স্টেইন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রতি ইনিংসে গড়ে ৫২ রান দিয়ে সংগ্রহ করেন ৮টি উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে স্টেইন ম্যাজিকের সেই শুরু।
আরও পড়ুন
১২৮ বছর পর অলিম্পিকে ফিরতে চলেছে ক্রিকেট
তারপর একের পর এক সাফল্যের মাইলস্টোন স্পর্শ করেছেন তিনি। পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখতে গেলে সতেরো বছরের ক্রিকেট জীবনে তাঁর সংগ্রহ ৬৯৯টি উইকেট। যার মধ্যে রয়েছে ৯৩টি টেস্ট ম্যাচে ৪৩৯টি উইকেট। ১৯৬টি শিকার রয়েছে ওয়ান ডে-তে। ফ্র্যাঞ্চাইসি ক্রিকেটেও বার বার ঝলসে উঠেছে তাঁর বিধ্বংসী ফর্ম। ২০১০ সালের পর থেকে টানা ৭ বছর, টেস্ট ক্রিকেটের বোলিং র্যা ঙ্কিং-এ এক নম্বর স্থান দখল করে রাখার অনন্য নজিরও রয়েছে তাঁর পকেটে।
আরও পড়ুন
সৌরভ-ঋদ্ধিমানের সতীর্থ, অবসাদে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন এই বঙ্গ ক্রিকেটার!
কিন্তু এত কিছুর পরেও দক্ষিণ আফ্রিকার মতোই ‘চোকার্স’ তকমা সঙ্গ ছাড়েনি তাঁর। সাফল্যের পাশাপাশি সমানভাবেই তাঁর সঙ্গে হেঁটেছে ‘ব্যর্থতা’-ও। ২০১৫-র বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের পর আঙুল উঠেছিল সেই তাঁর দিকেই। অকল্যান্ডের মাটিতে পর্যুদস্ত হওয়ার পর কোথাও যেন হতাশাও উঁকি দিয়ে উঠেছিল তাঁর নির্ভীক মননে। টলিয়ে দিয়েছিল আত্মবিশ্বাস। সেইসঙ্গে চোট তো ছিলই। মাত্র ১৩ মাসের মধ্যে দু-দু’বার কাঁধে চোট প্রায় শেষ করে দিয়েছিল তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার। টানা এক বছর তিনি নামতে পারেননি ক্রিকেট পিচেও।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর যে আর সঙ্গ দিচ্ছে না, তা ভালোই বুঝেছিলেন স্টেইন। ২০১৯ সালে তাই সীমিত ওভারের ক্রিকেটজীবন দীর্ঘায়িত করতে ইতি টেনেছিলেন টেস্ট কেরিয়ারে। নিজের জন্য কিনে নিতে চেয়েছিলেন আরও খানিকটা সময়। কিন্তু তাতেও লাভ হল না খুব একটা। অভিশাপের মতোই পিছু ছাড়ল না চোটাঘাত। তবে মাঠে ফেরা অসম্ভব ছিল না কখনোই। তবুও ৩৮-এই বিদায় নিলেন স্টেইন। ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই হয়তো জায়গা ছেড়ে দিলেন তরুণ প্রজন্মকে। শুধু রেখে গেলেন এক ঝাঁক রূপকথা। যা আজীবন সোনার মুহূর্ত হয়ে থাকবে ক্রিকেট ইতিহাসে…
Powered by Froala Editor