পথের কথা লিখতে বসি যখন, গন্তব্য এসেই পড়ে। কিন্তু এমন হয় না? যে পথের শেষ নেই, শুধু শুরু আছে। আর আছে শুধু একটা ভ্রমণ। এই ভ্রমণ দৃশ্যের সঙ্গে, অনুভব-অনুভূতির সঙ্গে। একার এই পথে সুর এসে মেশে, কথা এসে মেশে কিন্তু স্থায়ী নয়। দাগ রেখে যেতে পারে, কিন্তু সে দাগ অতটাও গভীর নয় কোনোমতে। একাকী নিবিড় পথিক সেই, আপনভোলার ঝুলি নিয়ে একের পর এক অক্ষর খুঁজে বেড়াবেন আর গাইতে গাইতে চলবেন তার নিশানাহীন পথ। আর সে পথে দৃশ্যটুকুই সম্বল। কোনোমতেই মায়া নয়, ছায়া নয়। ঝোলায় রাখা আছে অতীতের স্মৃতি; বর্তমানের যাপন। ব্যাস! এটুকুই।
কিন্তু পথ তো শুধু আনন্দের নয়। সুখের নয়। তার প্রতি পায়ে কাঁটা। প্রতি বাঁকে কাদা। আর এই কষ্টকে হার মানাতে হাঁটতে হাঁটতে পথিকের কাছে আসে সুরের অনুষঙ্গ। চারপাশের খোলা দৃশ্য তো রইল। সেখান থেকে সংগ্রহ করে নাও কথা। তৈরি হল অব্যর্থ দবাই। কথায়, সুরে জন্ম নিল 'ডহরিয়া গীত'...
চোখ দেখে কোনও পল্লী বালিকার নূপুরের শব্দ। কানে এসে বাজে গ্রাম্য কোন্দল। কোকিলের শিস। পথিকের ঘরছাড়া, ঘরহারা বেদুইন মন নেচে ওঠে... আর তখনই রচিত হয় অমোঘ সেই শ্লোক –
এই বাটে আওয়ে হলদরঙ্গিয়া রসিকা
ছুমুর ছুমুর নূপুর বাজি যায়
ঝাড়খণ্ডের ধলভূমগড় অঞ্চলে এই গীত এককালে প্রচুর শোনা যেত। এই অঞ্চল জঙ্গল প্রধান। যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা ছিল না বললেই চলে। একাকী নির্জন পথে, পাহাড়ি বাঁকে পথশ্রম লাঘব করার জন্য পথিক গানগুলো তাৎক্ষণিক রচনা করতেন। আর দৃশ্যের কাছ থেকে কথা ধার করে হাঁটতে হাঁটতে চলতেন, পার করতেন পথ।
কাঁকড়ি রে কাঁকড়ি রে
কাঁকড়ি ত চলিয়ে পালায়
প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং গ্রাম্য জীবনের গল্পই ছিল গানগুলির মূল বিষয়। ছিল পথের দেখা। পথকে অনুভব করা। অনেকটা আমেরিকার ফোক সং হাইওয়ে ব্লুজ-এর মতো। পথ হাঁটার গান। পথের গান... যে পথ মিশেছে গিয়ে সুরের, সফরের শেষে। যা ছিল বাংলার একান্ত নিজস্ব...