যৌবনে যে রত্নাকর ডাকাত ছিল, পরে সে-ই তপস্যার বলে বাল্মীকি মুনিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ডাকাত মানেই যে পরবর্তীতে সাধুতে পরিণত হবে এমন ভাবাও ভুল। সেই প্রাচীনকাল থেকে সমাজে একটা অ্যান্টি এস্টাবলিশইম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার জন্যই ডাকাতদের ভয়ে রাজা থেকে প্রজা সবাই কুঁকড়ে থাকত। রাতের অন্ধকারে মা কালীর পুজোর পর রণ-পা পায়ে হারে-রে করে যখন একের পর এক গ্রামে প্রবেশ করত, তখন সারাগ্রাম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে চুপ করে থাকত, আবার তাদের কাজ শেষ হলেই বনের আড়ালে বা পাহাড়ের গোপন গুহাতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করত।
আরও পড়ুন
ইংরেজদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন যে বাঙালি ফকির
রামায়ণ বাদ দিয়েও আমরা সেই সুদূর অতীত থেকেই পুরাণে, মহাভারতে এমনকি জাতকের কাহিনিতেও খুঁজে পাই বিখ্যাত সব ডাকাতদের কথা। সেই অতীত থেকেই তারা রাতে ডাকাতির পেশাতে নিযুক্ত থাকলেও দিবালোকে কৃষিজীবী, শ্রমিক বা নৌকার মাঝির কাজে যুক্ত থেকে গোপনে বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করত। পেশিবহুল শরীরকে ঠিক রাখতে ডনবৈঠকের সঙ্গেই চলত রায়বেঁশে নাচের কলাকৌশলের সুচারু অভ্যাস।
সেই সময়ের কলকাতায় শোভাবাজার অঞ্চল ও শিমলাপল্লির ভেতরে ডাকাতদের বিরাট আস্তানা ছিল।
এ-প্রসঙ্গে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ইংল্যান্ডের রানির হাতে শাসনভার অর্পিত হলে, প্রাদেশিক শাসন থেকে ক্রমে কেন্দ্রীয় শাসন শুরু হয়। তাতে দেশীয় জমিদার আর রাজাদের প্রাদেশিক ক্ষমতাভার হ্রাস পায় এবং অগণিত পাইক-লেঠেল তাদের জীবিকা হারায়। পরে বাধ্য হয়ে তারাই গভীর বনে বা গুহার আড়াল থেকে ডাকাতিকে পেশা হিসাবে তুলে ধরে সারাবাংলায়।
'অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল' গ্রন্থে হান্টার সাহেব উল্লেখ করেছিলেন বিভিন্ন স্থানের ডাকাতদের স্থান পরিবর্তনের কথা, যেখানে বীরভূমের ডাকাতরা বর্ধমানে অথবা বর্ধমান জেলার ডাকাতরা নদিয়াতে গিয়ে ডাকাতি করত। হান্টার সাহেব সেইসব ডাকাতদের সংখ্যার একটা নমুনা দিয়েছিলেন যা স্থান হিসাবে উত্তরবঙ্গে ৩০০-৪০০ জন, মধ্য ও দক্ষিণবঙ্গে এক হাজার প্রায়!
শাস্তি হিসাবে তাদের ডান হাত আর বাঁ পা কেটে নেওয়া হত। তারপরই ক্ষতের উপর গরম ঘি ঢেলে দেওয়া হত, যাতে নিশ্চিতভাবে মারা যায়।
এলাকার ভিত্তিতে ডাকাতি করার একটা যুক্তি ছিল যে, সহজে লোক তাদের চিনতে পারবে না। তাই বারবার জেলা পালটে পালটে ডাকাতির ছক কষত তারা। অনেক ক্ষেত্রেই আগে থেকে চিঠি দিয়ে ডাকাতির দিন ঘোষণা করাকেও বীরত্বের নজির হিসাবে মনে করত। তবে তারা শুধু জমিদার বাড়িই লুঠ করত না, নদীপথে নৌকা বা খোদ কলকাতার রাস্তাতে জুড়িগাড়িও লুঠত। পলাশীর যুদ্ধ-পরবর্তী দু-তিন দশক পরের সময়ে কলকাতাতে রাত আটটার পর মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে চাইত না ডাকাতদের ভয়ে। সেই সময়ের কলকাতায় শোভাবাজার অঞ্চল ও শিমলাপল্লির ভেতরে ডাকাতদের বিরাট আস্তানা ছিল।
তবে, আস্তানার স্থান হিসাবে তারা ছড়িয়েছিল বাংলার প্রতিটা জেলায় জেলায় এবং পরে সেই বিখ্যাত ডাকাত দলের সর্দারের নাম থেকে বিভিন্ন জায়গায় নামকরণও হয়। যেমন, কুখ্যাত রানা ডাকাতের নাম থেকে রানাঘাট, ভুবন ডাকাতের নাম থেকে বোলপুরের ভুবনডাঙার মাঠ বা কলকাতার চিতে ডাকাত থেকে আজকের চিৎপুর।
ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়েও বহু ডাকাত সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল। তাদের ডাকাতির ধরণটা ছিল ধনীদের সম্পদ লুঠ করে গরিবদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া। এইসব ডাকাতদের নাম নিলে প্রথমেই আসে যাঁর নাম, তিনি হলেন বিশ্বনাথ সর্দার ওরফে বিশে ডাকাত। সোনার গহনা পরে তিনি পালকিতে ঘুরে বেড়াতেন সবসময়। তিনি ধনীদের লুঠ করা ছাড়াও অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সাধারণ গরিব মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মসিহার মতো। পরে তাঁর জীবন সম্পর্কে অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্যিক শ্রীশচন্দ্র মিত্র 'বিশ্বনাথ' উপন্যাস লেখেন।
তবে ডাকাত মানেই যে জমিদার বা ভূস্বামীদের বিরোধী ছিল, তাও কিন্তু নয়! অনেক জমিদার নিজেও ডাকাত দল পুষতেন এবং সেই দলের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী জমিদারদের সম্পত্তি লুঠ করতেন, এভাবেই তাঁরা নিজেদের সম্পত্তি বৃদ্ধি করতেন। একসময় জনশ্রুতি চালু ছিল যে, মহিষাদলের রাজার মাইনেভুক্ত ডাকাত দল ছিল, এছাড়াও বর্ধমান বা বীরভূমের বহু জমিদার গোপনে ডাকাত দল পুষতেন। তাতে অনেক সময় ধরা পড়ে যেত তারা। শাস্তি হিসাবে তাদের ডান হাত আর বাঁ পা কেটে নেওয়া হত। তারপরই ক্ষতের উপর গরম ঘি ঢেলে দেওয়া হত, যাতে নিশ্চিতভাবে মারা যায়। ভাগ্যবলে বেঁচে থাকলে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কিছু উপায় থাকত না।
ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়েও বহু ডাকাত সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল
ডাকাতিতে চিরকালই বর্ধমান জেলা একটি উল্লেখযোগ্য স্থান, কারণ জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। বর্ধমানে ডাকাত বললে উঠে আসে জীবনা ডাকাতের নাম, যে ১৭৭০-৮০র দশকে সেনপাহাড়ি পরগনাতে ভয়ঙ্কর সব ডাকাতি করে বেড়াত।
দেশকাল পেরিয়েও সেইসব ডাকাতদের কথা আজও মনে গেঁথে আছে, সেটা যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বই 'বাংলার ডাকাত' পড়েই হোক বা বাংলায় সিনেমাতে ডাকাতি কাহিনি দিয়ে, অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ কবিতার সেই বীরপুরুষ সন্তানের ডাকাত তাড়ানো দিয়ে। বাংলার জনমানসে ডাকাতরা সবসময় বেঁচে আছে সেই সুদূর অতীতের ভয়ে, ভক্তিতে বা সাহিত্যের উপাদানে।