তামিলনাড়ুর (Tamil Nadu) পুথুরাই গ্রাম (Puthurai Village)। পাশেই ওসুদু হ্রদ। সেই হ্রদ থেকেই সরু জলধারা প্রবাহিত হচ্ছে গ্রামের মধ্যে। অবশ্য নদী বলা চলে না এই জলধারাকে। তবে সংকীর্ণ এই খালই গ্রামবাসীদের কথায় ‘নদী’। আর এই নদীর উপত্যকাতেই প্রায় ১০০ একর জমি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড এক অরণ্য। কয়েকশো প্রজাতির প্রাণীর বাস সেখানে। পাখির কলরবে ভরে রয়েছে আকাশ-বাতাস। কিন্তু যদি বলা হয় এই গোটা অরণ্যটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা?
এমন কথা শুনলে একটু চমকে উঠতে হয় বইকি। তবে আজ থেকে তিন দশক আগেও এই অঞ্চলে এমন কোনো অরণ্যের অস্তিত্বই ছিল না। তেমন উর্বর ছিল না মাটিও। তবে বিগত ৩০ বছর ধরে একক প্রচেষ্টায় এই অঞ্চলের রূপ বদলে ফেলেছেন এক পরিবেশবিদ।
ডি সারাভানান (D Saravanan)। ভারতীয় প্রকৃতি সংরক্ষকদের তালিকায় প্রথম সারিতেই উঠে আসে ভিলুপুরম জেলার ৫৩ বছর বয়সি এই ব্যক্তির নাম। ‘সেভ ওয়েস্টার্ন ঘাটস’ আন্দোলন থেকে উত্তরাখণ্ডের তেহরি বাঁধ বিরোধী আন্দোলন বা দক্ষিণ ভারতীয় ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ— একাধিকবার পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণের দাবিতে সরব হয়েছেন সারাভানান। চিপকো আন্দোলনে তাঁকে দেখা গিয়েছিল সুন্দরলাল বহুগুণার অন্যতম সহকারী হিসাবে। তামিলনাড়ুর পুথুরাই গ্রামের ‘অরণ্য ফরেস্ট অ্যান্ড স্যাংচুয়ারি’-র রূপকারও তিনিই।
পণ্ডিচেরীতে অবস্থিত অরোভিল গ্রামে শুরু হয়েছিল সারাভানানের প্রকৃতি-সাধনা। ৮০-র দশকের শুরুর দিক। ঋষি অরবিন্দের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রামে জৈব চাষের প্রশিক্ষক এবং পরিবেশ শিক্ষার সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন সারাভানান। সেখান থেকেই জড়িয়ে পড়া অরোভিল গ্রিন ওয়ার্ক রিসোর্স সেন্টারের সঙ্গে। এই সংস্থার হয়েই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রুক্ষ-শুষ্ক জমিতে অরণ্যায়নের কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৯০-এর দশকে পূর্ব ও পশ্চিমঘাট পর্বতের বেশ কিছু স্থানীয় প্রজাতির সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিন।
এর প্রায় এক দশক পর, ৯০-এর দশকের শুরুতে নিজের গ্রামে ফেরার পর, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল পুথুরাইয়ের ওসুদু হ্রদ সংলগ্ন অঞ্চলটি। গুটি কয়েক পালমাইরা গাছ ছাড়া, গোটা অঞ্চলটাই ছিল মরুভূমির মতো। অথচ, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল পড়ে রয়েছে সম্পূর্ণ অব্যবহৃত হয়ে। সেখানে যেমন মানুষের বসবাস নেই, তেমন চাষাবাদও হয় না। কিন্তু অব্যবহৃত এই জমিকেই যদি বদলে ফেলা যায় বাস্তুতন্ত্রের আধারে? চিন্তা দানা বাঁধতে শুরু করে সারাভানানের মনে।
১৯৯৪ সাল। অরোভিলের আরও দুই প্রকৃতি সংরক্ষক রউফ আলি এবং অরো নাভির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সারাভান শুরু করেন অরণ্যায়ন প্রকল্প। লাল ল্যাটেরাইট মৃত্তিকায় কী কী ধরনের গাছ জন্মাতে পারে, তাদের বৃদ্ধির জন্য কীধরনের পরিবেশ প্রয়োজন— এসব নিয়েই চলত নানাধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা। ১৯৯৪-১৯৯৭— মাত্র তিন বছরের মধ্যে ৩৬ হাজারেরও বেশি দেশীয় ও স্থানীয় উদ্ভিদের চারা রোপণ করেন সারাভানান। অবশ্য পুরোপুরি সফল হননি তিনি। রুক্ষ পরিবেশে শেষ পর্যন্ত টিকে গিয়েছিল বিশেষ কিছু প্রজাতি। পরবর্তীতে সেই প্রজাতিগুলিকে চিহ্নিত করেই গণহারে অরণ্যায়ন শুরু করেন সারাভানান। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমে সবুজের আচ্ছাদনে সেজে ওঠে গোটা অঞ্চলটি।
বর্তমানে ‘অরণ্য ফরেস্ট’-খ্যাত এই সংরক্ষিত অঞ্চল ২৪০টিরও বেশি পাখি, ৫৪টি প্রজাপতির প্রজাতি, অসংখ্যা সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস অঞ্চলে। তাছাড়াও ঈগল আউল, স্লেন্ডার লরিস, ডেরিস ওভালিফোলিয়ার মতো বিপন্ন প্রজাতির দেখা মেলে ‘অরণ্য’-এ। সবমিলিয়ে বলতে গেলে সারাভানানের এই উদ্যোগ যেন বদলে গিয়ে গোটা অঞ্চলের জীববৈচিত্রকেই। তবে এখানেই শেষ নয়। আজ এই অরণ্যের পরিধিবৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সারাভানান। চলছে গ্রামের স্থানীয় মানুষদের প্রকৃতির সম্পর্কে সচেতন করার লড়াই। কে বলতে পারে, তাঁর এই উদ্যোগ থেকেই হয়তো উঠে আসবে ভবিষ্যতের সারাভানানরা…
Powered by Froala Editor