প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। কয়েক বছর হল, ব্রিটিশরা ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত করেছে দিল্লিতে। কলকাতার বইপাড়ায় দাপিয়ে রাজত্ব করছে ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’। তেমনই একটা সময়ে, শহর কলকাতার বুকে জন্ম নিল নতুন এক প্রকাশনা সংস্থা। নাম – ‘ডি এম লাইব্রেরি’।
৬৪ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের দোকানটিতে একসময় পা রাখার জায়গা থাকত না। লাহোর থেকে রেঙ্গুন - ভারতের বিভিন্ন অংশে ডি এম লাইব্রেরি থেকে বই পাঠানো হত। তখন দোকানে হইহই অবস্থা। স্বাধীনতার পূর্বে শুরু হওয়া এই দোকানকে তাই ‘সর্বভারতীয়’ বললে ভুল বলা হবে না। কে না এসেছেন এই ‘আট বাই ছয়ের’ গণ্ডিতে! মান্না দে, অন্নদাশঙ্কর রায়, বারীন ঘোষ, প্রমথ চৌধুরী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও আরও কতজন! কত লেখক বইপাড়াতে গেলে জনপ্রিয়তার খাতিরে বিনামূল্যে বই পেতেন। তবুও তারা এখানে আসতেন। ধৈর্য ধরে মূল্য দিয়ে বই কিনতেন বর্তমান বিবেকানন্দ রোডের এই ঠিকানা থেকে।
কিন্তু এই প্রকাশনা সংস্থার শুরু কীভাবে? জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে অগ্নিযুগের দিনগুলিতে। গোপাল দাস মজুমদার বিপ্লবী বাঘাযতীনের শিষ্য ছিলেন। বাঘাযতীনের মৃত্যুর পর পার্টি ভেঙে যায়। মানবেন্দ্রনাথ রায় বিদেশে চলে যান। সে সময় পার্টির সূত্রে আরেকজন ফেরার বিপ্লবীর ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট ব্যবহার করে রাঁচির এ জি বেঙ্গলে চাকরি পান। দু বছর কেটে যাবার পর পার্মানেন্ট হবার সময় আসে। পুলিশ তাঁকে তখন হন্য হয়ে খুঁজছে। এ সময় যার ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট তিনিও নিরুদ্দেশ, গোপালবাবুও নিরুদ্দেশ। এরই মধ্যে গোপালবাবু ভাইকে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে রাঁচির ঠিকানা দেওয়া ছিল। পুলিশ দুইয়ে দুইয়ে চার করে এবং এ জি বেঙ্গল রাঁচির ব্রাঞ্চে এক সাহেবকে গোপালবাবুকে আটকে রাখতে বলেন। সাহেব গোপালবাবুকে এ কথা জানিয়ে অগ্রিম দু মাসের মাইনে দিয়ে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তারপর এখানে সেখানে চাকরি, কখনো টাটা, কখনো অন্য কোনোখানে। এভাবেই একদিন তিনি কলকাতা পৌঁছান। সেখানে তাঁর না আছে বাসস্থান, না আছে খাদ্য সংস্থান। পার্টির মেম্বারদের বাড়িতে পালা করে দিন গুজরান, কখনো এই মেস তো কখনো ওই মেস।
তখন বারীন ঘোষ দ্বীপান্তর থেকে সদ্য ফিরেছেন, সাল ১৯২০। নলিনীকান্ত সরকার গোপালবাবুকে বারীন ঘোষের কাছে নিয়ে যান কাজকর্মের জন্য। সে সময় ‘বিজলী’ পত্রিকার পথ চলা শুরু। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিলেন গোপালবাবু। মাসিক পঁচিশ টাকা বেতন, সঙ্গে মেসে থাকার জায়গা। এ দপ্তরেই হাতেখড়ি তাঁর। ম্যানেজার ছিলেন বিধুভূষণ দে। দুজনে এ-বই ঘাড়ে করে বিক্রি করতেন। এরপর একদিন তারা বারীন ঘোষের কাছে আর্থিক টানাটানির কথা জানালে, তিনি তাঁদের একটি বইয়ের দোকান খোলার উপদেশ দেন। বিধুভূষণ দের ডি এবং গোপাল দাস মজুমদারের ‘এম’ জুড়ে, শুরু হয় ডি এম লাইব্রেরির যাত্রা।
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় ডি এম লাইব্রেরির প্রথম বই ‘বারীন্দ্রের আত্মকথা’। প্রকাশক বিধুভূষণ দে এবং গোপাল দাস মজুমদার। তখনকার ঠিকানা ছিল 93/1A বৌবাজার স্ট্রিট। একটা ভাঙা ক্যাশবাক্স, আলমারি ও চেয়ার সম্বল করে প্রথমে মানিকতলার একটি মেসে থাকা শুরু করেন। পরে উঠে আসেন 64/1 কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে। বই বলতে তখন সম্বল 'বারীন্দ্রের আত্মকথা', শচীন সেনগুপ্তর ‘চিঠি’, নলিনীকান্ত গুপ্তের ‘স্বরাজ গঠনের ধারা’, সুরেশ চক্রবর্তীর ‘সাকি’। সে সময় সাকির কবিতা বেশ আলোচিত। কেউ কেউ তাকে অশ্লীল বলে তকমাও দিয়েছিল। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত, অবিনাশ ভট্টাচার্যের আত্মকাহিনিও বিক্রি হত ভালোই।
দোকানঘর তখন এত ছোটো যে, আলমারি-বই-চেয়ার রাখার পর গোপালবাবুকে বাইরেই বসতে হত। ক্রেতা, বন্ধুবান্ধব সবাই ইট পেতে বাইরেটায় বসতেন। এরমধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হয় ‘বিজলী’ পত্রিকায়। আসলে সেটি প্রকাশ হবার কথা ছিল ‘মোসলেম ভারত’-এ। এর মধ্যে আর্য পাবলিশিং হাউস জানায় যে, তারা আর কোনোপ্রকার বিপ্লবীদের বই ছাপবে না। শুধুমাত্র অরবিন্দের বই ছাড়া আর কোনো বই তারা রাখবে না। আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে নজরুলের প্রকাশিত বই 'অগ্নিবীণা' এবং 'দোলনচাঁপা' তুলে নিতে বলা হয়। নজরুল ডি এম লাইব্রেরিকে প্রস্তাব দেন এই বই করার। প্রসঙ্গত, তখন অগ্নিবীণা দুটি এডিশনে একেকবারে বাইশশোটি করে ছাপা হয়েছিল। গোপালবাবু জানান, আর্য পাবলিশিং হাউসের মতো অত টাকা তিনি দিতে পারবেন না। নজরুল নাছোড়। শেষে ডি এম লাইব্রেরি থেকেই ‘দোলনচাঁপা’ প্রকাশিত হয়।
নজরুলের খ্যাতি তখন তুঙ্গে, সঙ্গে বেড়েছে পাগলামিও। কতদিন নজরুল সারাদিন ট্যাক্সি করে ঘুরে এসে গোপালবাবুর কাছে ভাড়া মেটানোর টাকা চেয়েছেন। চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা মিটার, না খেয়ে গোপালবাবু মিটিয়েছেন সেই ভাড়া। তারপর সারারাত দোকানেই অনাহারে শয়ন। তখন বাংলার সব থেকে বড়ো প্রকাশনা ছিল গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের। সেখান থেকে শরৎচন্দ্রের বই বেরোত। কল্লোলযুগের লেখকদের বই ছাপা হলে তিনি আর গুরুদাসকে বই দেবেন না, এ-কথাও বলেছিলেন শরৎচন্দ্র। ধীরে ধীরে প্রকাশনা পড়তির দিকে এগোয়। এসময় কল্লোল যুগের লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কিংবা বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের বই প্রকাশ করে ডি এম লাইব্রেরি। এরই মধ্যে বিজলীর জন্য লেখা আনতে যাবার সূত্রে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হয় গোপালবাবুর। খুশি হয়ে তিনি কিছু বই ছাপার জন্য ডি এম লাইব্রেরিকে দিয়ে দেন।
গোপাল দাস মজুমদারের এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তিনি লেখা দেখে বুঝতে পারতেন কোন বই বাজারে বিক্রি হবে। কিন্তু তিনি কখনো কোনো বিভেদ করেননি। কল্লোল যুগের লেখক, কিংবা শনিবারের চিঠির লেখক, বিপ্লবীদের লেখা সবই লেখার গুণ থাকলে প্রকাশ করতেন। এরইমধ্যে কল্লোলের অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বিবাহে নিমন্ত্রিত হন গোপালবাবু । আলাপ হয় সেখানে সদ্য 'পথে প্রবাসে' লিখে জনপ্রিয় হওয়া অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে। এক অন্যরকমের ভ্রমণকাহিনি, যা তখন বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদৃত। এসময় গোপালবাবু অন্নদাশঙ্কর রায়কে উপন্যাস লেখার প্রস্তাব দেন। অন্নদাশঙ্কর তখন আই এস অফিসার। লেখা নিয়ে তিনি তখন ভাবছেন না, তবু তিনি জানাবেন বলেন। একবার ময়মনসিংহ থেকে বহরমপুর আসার পথে তাঁর মাথায় উপন্যাসের প্লট আসে। গোপালবাবুকে তিনি চিঠিতে সেকথা জানান। তাঁর লেখা ‘আগুন নিয়ে খেলা’ প্রকাশিত হয় ডি এম লাইব্রেরি থেকে। রয়্যালটির পরিমাণ ছিল দুশো কী তিনশো টাকা। যত অনটনই থাক না কেন, গোপালবাবু সে টাকা পাঠিয়ে দিতেন।
ডি এম লাইব্রেরি কখনোই কোনো দলাদলি করেননি। বামপন্থী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা সমরেশ বসু, অনেকেরই প্রথম বইয়ের প্রকাশক ডি এম লাইব্রেরি। কল্লোলের বুদ্ধদেব বসুর সূত্রে আলাপ জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে। ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রথম প্রকাশ পায় ডি এম লাইব্রেরি থেকেই । অজিত দত্তের ‘কুসুমের মাস’ প্রকাশ হয় এখান থেকে। এই ভাগলপুরে যাতায়াতের সূত্রে বনফুলের সঙ্গেও আলাপ ছিল গোপালবাবুর। একাধারে বইয়ের প্রুফ নিয়ে দোকানে ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি। আবার যখন বাড়িতে প্রুফ দিতে গেছেন, তাঁর হাতে মডার্নের পাউরুটি তুলে দিচ্ছেন বনফুল। তখন মডার্ন নতুন এসেছে কলকাতায়। সে পাউরুটির স্বাদ আলাদা। নিজের সংসারের সঙ্গে গোপালবাবুর জন্যও কিনে এনেছেন বনফুল। কারণ গোপাল ভালোবাসেন এই পাউরুটি খেতে।
আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের সূত্রে যাতায়াতের ফলে আলাপ রমাপদ চৌধুরী এবং বিমল করের সঙ্গে। পরবর্তীতে তাঁদের বই ছাপতে তাই অসুবিধে হয়নি। এইসূত্রে পূর্ণেন্দু পত্রীও প্রথমে পারিশ্রমিকসহ এবং পরে বিনা বেতনেই কভার করে দিতেন ডি এম লাইব্রেরির । অনেক বই সাহস করে গোপালবাবু করেছেন, যা তখন অন্য প্রকাশনা করার থেকে পিছিয়ে এসেছে। স্টেটসম্যানের এডিটর অমলেন্দু দাশগুপ্ত প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ নিয়ে লিখেছিলেন যা ডি এম লাইব্রেরি ছেপেছিল। ভারিক্কি প্রাবন্ধিক জাহ্নবী চক্রবর্তী, হরপ্রসাদ মিত্রের বইও এখান থেকেই বেরিয়েছে।
একবার ময়মনসিংহের জমিদার রাধিকামোহন মিত্র আসেন গুরুদাসবাবুর দোকানে। সেখানে দেড় হাজার টাকার বইয়ের অর্ডার দেন, যা তখন বিপুল। দুশো টাকা কম পড়ায় রাধিকামোহন জানান যে তিনি তা পাঠিয়ে দেবেন দ্রুতই। কিন্তু সংস্থা থেকে বলা হয় যে, এরকম জমিদার তারা অনেক দেখেছেন। পুরো অর্থ না পেলে বই দেওয়া হবে না। রাধিকামোহন একটিও বই না নিয়ে ডি এম লাইব্রেরিতে আসেন এবং সেখান থেকেই বই কেনেন।
আজ বহু ঝাঁ চকচকে প্রকাশনার ভিড়ে এই ঐতিহাসিক সংস্থা বড়ো নিষ্প্রভ। বর্তমান ঠিকানা ৪২ নং বিধান সরণিতে আগে অক্সফোর্ড মিশনের সামগ্রী বিক্রি হত। সাহেব বেহালায় দোকান উঠিয়ে নিয়ে যাবার সময় গোপালবাবু এ-দোকান ভাড়া নেন। সেই থেকে বিবেকানন্দ রোডের এই দোকানেই পাঠকের যাতায়াত। ডি এম লাইব্রেরি আবার লড়াই করে ফেরাতে চাইছে সেই স্বর্ণযুগ। তারা ভাবছেন কিছু বই পূনর্মুদ্রণ করবার কথা। সময়ই বলবে, বাঙালি কতটা আপন করে নেবে শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রকাশনাকে। নাকি, তার দিন সত্যিই গিয়াছে?
Powered by Froala Editor