২০১৬ সাল। উড়ো নম্বর থেকে একটি সন্দেহজনক মেসেজ পেয়েছিলেন আরবের এক সমাজকর্মী। পাঠানো হয়েছিল একটি ওয়েবসাইটের লিঙ্ক। প্রথমে অবশ্য বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব দেননি তিনি। কিছুদিন পরেই বুঝতে পারেন, অজানা কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে তাঁর ফোন। রীতিমতো হ্যাকিং-এর শিকার তিনি। তৎক্ষণাৎ অ্যাপেলের দপ্তরে যোগাযোগ করেছিলেন আরবের ওই সমাজকর্মী। পরীক্ষা করে দেখা যায় সত্যিই তাঁর ফোন হ্যাকড। আর নিরাপত্তা বাড়াতে সে সময় আইওএস-এ বেশ কিছু বদলও আনে অ্যাপেল। কিন্তু কারা যুক্ত ছিল সেই হ্যাকিং-এর সঙ্গে?
গতকাল থেকেই আলোচনার হট টপিক এখন ‘পেগাসাস’। রবিবার পেগাসাস নিয়ে প্রথম অভিযোগ তোলেন রাজ্যসভার সংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। টুইট করে জানান, ভারতের বিশিষ্ট নেতা-মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি-সহ একাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের ফোনে আড়ি পাতছে হ্যাকাররা। আর তাঁদের হাতিয়ার ‘পেগাসাস’ নামের একটি স্পাইওয়্যার। শুধু তিনিই নন, ডেরেক ও’ব্রায়েন, কার্তি চিদাম্বরম-সহ একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরব হন এই দাবির পক্ষে। তারপর ভারত তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরে শোরগোল পড়ে যায় পেগাসাস নিয়ে। শেষ পর্যন্ত গতকাল রাতেই যবনিকা পতন হল পেগাসাস রহস্যের। প্রকাশিত হল বিস্তারিত রিপোর্ট।
হ্যাঁ, ২০১৬ সালে আরবে ঘটে যাওয়া সেই হ্যাকিং-এর নেপথ্যে ছিল পেগাসাসই। পেগাসাসের অস্তিত্ব সামনে এসেছিল সেই প্রথমবার। তারপর ২০১৯ সালে পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল এই হ্যাকিং প্ল্যাটফর্ম। আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের ফোন ট্যাপিং-এর অভিযোগ উঠেছিল পেগাসাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু এই ‘পেগাসাস’ আসলে কী?
সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, আলাদা কোনো সফটওয়্যার নয় বরং পেগাসাস স্পাইওয়্যার। কোনো ধরনের এসএমএস, লিঙ্ক কিংবা মিসড কল দিয়েও যে কোনো ব্যক্তির ফোনে ইনস্টল করে ফেলা যেতে পারে এই স্পাইওয়্যারটিকে। তারপরেই ফোনের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সেই সংস্থার কাছে। ফোন ট্যাপিং তো বটেই, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, এমনকি যে কোনো ব্যক্তিগত তথ্যের ওপরেই নজর চালানো সম্ভব পেগাসাসের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন
হ্যাক হতে পারে ডিজিটাল পেসমেকারও! আশঙ্কায় চিকিৎসক থেকে ইঞ্জিনিয়াররা
‘সাইবার ওয়েপন’ খ্যাত এই বিশেষ স্পাইওয়্যারটি তৈরি করেছে ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও গ্রুপ। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এখনও পর্যন্ত গোটা বিশ্বে প্রাপ্ত স্পাইওয়্যারদের মধ্যে সর্বাধুনিক পেগাসাস। অ্যাপেল আইফোনের শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও যা অনায়াসেই ভাঙতে সক্ষম। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল কেবলমাত্র আইওএস-এর ওপরেই হানা চালায় পেগাসাস। তবে পরবর্তীতে বদলে যায় ধারণা। গবেষকরা লক্ষ করেন, অ্যান্ড্রয়েডের ওপরেও সমানভাবে কার্যকরী এই স্পাইওয়্যার।
আরও পড়ুন
হ্যাকার-হামলায় প্রশ্নের মুখে লিংকডইন, নিলামে ৫০ কোটি গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য
কিন্তু পেগাসাসকে ব্যবহার করে কারা চালাচ্ছে এই হ্যাকিং? প্রস্তুতকারক সংস্থার দাবি, এই সফটওয়্যার মূলত সরকারকেই প্রদান করে তারা। এবং বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়। তবে এর বাইরে পেগাসাসের অপব্যবহার সম্পর্কে কোনো দায় নেই তাঁদের। ফলত, স্বাভাবিকভাবেই আঙুল উঠছে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেই। অন্যদিকে ফোনে আড়ি পাতা নিতে সমস্ত ধরনের বিতর্ককেই নস্যাৎ করে দিয়ে কেন্দ্র জানিয়েছে এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। বরং, নিরাপত্তা জোরদার করতেই তথ্য প্রযুক্তি আইন লাগু করা হয়েছে বলে জানাচ্ছে কেন্দ্র।
‘দ্য ওয়্যার’-এর রিপোর্ট বলছে, ভারতের চল্লিশ জনের বেশি বিশিষ্ট ব্যক্তির ফোনেই ‘হামলা’ চালিয়েছে পেগাসাস। তবে আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা তিন শতাধিক। তার মধ্যে রয়েছেন দ্য হিন্দু, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-সহ দেশের প্রথম সারির একাধিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা। রয়েছেন আইনজীবী, রাজনৈতিক দলনেতা, সরকারি আধিকারিক-সহ বহু ব্যক্তিত্ব।
অন্যদিকে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিস্তারিত একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, পেগাসাস কাণ্ডের পিছনে বড়োসড় হাত রয়েছে হাঙ্গেরি প্রশাসনের। হাঙ্গেরির উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান সংবাদমাধ্যমকে শায়েস্তা করতেই বিশেষভাবে এই স্পাইওয়্যারের ব্যবহারে জোর দিয়েছেন। এই তর্কে উঠে এসেছে ইজরায়েলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিনের নামও।
সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে একাধিক দেশ মিলিয়ে হাজারেরও বেশি ব্যক্তিত্ব আক্রান্ত এই অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যারে। কিন্তু কতটা তথ্য চুরি করতে পেরেছে পেগাসাস, তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও। তবে সেই রহস্যও প্রকাশ পেতে আর খুব বেশি দেরি নেই…
Powered by Froala Editor