সাল ১৯৫৯। দিল্লির পিলানা ব্লকের কাছের একটি ছোট্ট স্কুলে সাজো সাজো রব। সমস্ত জায়গায় গোছগাছ চলছে। সামর্থ্য সামান্যই, তার মধ্যেও যতটুকু সাজানো যায়। আশেপাশের বাসিন্দারা একটু অবাক হলেন। কোনো বিশেষ উৎসব নাকি আজকে? অবাক হয়ে গেলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। উৎসব হতে যাবে কেন, আজ যে স্কুলে অতিথিরা আসবেন! ভারত সরকারের তরফ থেকে প্রতিনিধিরা আসবেন। সঙ্গে নাকি আসবেন এক বিদেশি সাহেবও…
একসময় এলেনও তাঁরা। বিদেশি সাহেবও এলেন। তবে অন্যান্যদের মতো ইনি নন। কেতাদুরস্ত পোশাক পরেননি, অযথা অহংকার নেই। শান্ত, ঋজু শরীরটায় একটা অদ্ভুত তেজ আছে। সবাই তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। হালকা দাড়ি, সিগনেচার মিলিটারি পোশাক; সঙ্গে মাথায় কিউবান হ্যাট। চোখ যেন চকচক করছে। দিল্লির ওই স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে যেন নিজেই মিশে গেলেন কিউবার মন্ত্রী ও দূত, কমান্ডার আর্নেস্টো ডে লা সেরনা। যে মানুষটিকে গোটা বিশ্ব চেনে হাভানা চুরুট আর চে গ্যেভারা নামে।
কখনও সেই বিখ্যাত টুপি, কখনও জামায় তাঁর মুখ, কখনও আবার ট্যাটু। চে গ্যেভারা আজও নানাভাবে ছড়িয়ে আছেন গোটা বিশ্বে। শুধু স্টাইল স্টেটমেন্টে নন, ছড়িয়ে আছেন বিপ্লবের মন্ত্রে, সাহসে। ওই হাভানা চুরুটের গায়ের মতো আগুন জ্বলে উঠুক সমাজের সমস্ত জায়গায়; তার তাজা গন্ধ নিক আমজনতা। স্বৈরাচারী শাসন নয়, ঔপনিবেশিকতা নয়; বরং সাম্যের বাণী তৈরি হোক। কৃষক-শ্রমিক সহ সমাজের মধ্যবিত্ত সাধারণ শ্রেণী, যারা নিজেদের স্বপ্ন দেখছে বদ্ধ জলাশয়ে; তাঁদেরকে খোলা আকাশ দেখানোর জন্যই চে-র মতো মানুষরা আসেন। আবার মিলিয়েও যান…
কিউবা, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়াতেই তাঁর বিচরণ। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। একটা সময় চলে গিয়েছিলেন আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশে। সেই সূত্রেই চলে এসেছিলেন ভারতেও। তবে এর উপলক্ষ্যটা সংক্ষেপে বলে নেওয়া ভালো। আমেরিকা মহাদেশে সেই সময় চে গ্যেভারা’র মতো আরও একজন বিপ্লবী ছিলেন— ফিদেল কাস্ত্রো। কিউবার স্বৈরাচারী শাসন থামিয়ে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে সেখানকার মসনদে বসলেন। তার আগেই চে-র সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ফিদেল তাঁকে আহ্বান করলেন নতুন কিউবায়; যোগ দিতে বললেন তাঁর মন্ত্রিসভায়। সেখানেই শ্রমমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন চে। তখনই ফিদেলের কথায় তিনি চলে গেলেন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলি ঘুরে দেখতে।
আরও পড়ুন
‘অন্ধকার’ সুন্দরবনে আলো ফেরাতে পৌঁছে যাচ্ছে সোলার ল্যাম্প
ফিদেল কাস্ত্রো যখন কিউবার মসনদে বসলেন, তখন যে দেশগুলো তাঁকে সবার আগে সমর্থন জানিয়েছিল, অভিনন্দন জানিয়েছিল; তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম। তিন মাস ধরে অন্তত ১৭টি দেশ ঘোরার সময় ভারতকে কিছুতেই ভুলে যাননি চে। ১৯৫৯ সালের ৩০ জুন, দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে পা রাখলেন বিপ্লবের সন্তান আর্নেস্টো চে গ্যেভারা। সেটাই প্রথমবার, সেটাই শেষবার…
আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত পাক ক্রিকেটার শাহিদ আফ্রিদি, সোশ্যাল মিডিয়ায় জানালেন নিজেই
পরেরদিনই দেখা হয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু’র সঙ্গে। দুই রাষ্ট্রের প্রতিনিধির মধ্যে সাধারণত যা কথা হয়, তা-ই হল। তবে চে’র ভারত পরিক্রমা শুধু এতেই সীমাবদ্ধ থাকল না। তিনি সব জায়গায়, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গ্রামে, শহরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। সেই সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সাংবাদিক কেপি ভানুমূর্তিকে একটি সাক্ষাৎকারও দেন তিনি। যা ভারতের ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় দলিল হয়ে থাকবে। সেখানে তাঁর কথায় সাম্যবাদ, কমিউনিজম তো উঠে এসেছিলই; সেই সঙ্গে উঠে এসেছিল ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ, সংগ্রাম এবং, মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁর সত্যাগ্রহের কথা!
আরও পড়ুন
জানুয়ারিতেই পা দিয়েছিলেন শতবর্ষে, প্রয়াত ভারতের প্রবীণতম জীবিত ক্রিকেটার
এই সময়ই চে গ্যেভারা যান অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট এবং ন্যাশনাল ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে। এখানেই তিনি জীবনে প্রথমবার দেখেন মেটাল ডিটেক্টর! রীতিমতো অবাক হয়ে যান তো বটেই, শেষে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এর কার্যপ্রণালীও বুঝে নেন। দিল্লি থেকে এরপর চে-র পা পড়ে কলকাতায়। আর এই শহর তাঁর ভেতর আরও একজনকে ঢুকিয়ে দেয়। কৃষ্ণ! অবাক লাগলেও, এরপর থেকেই চে বারবার কৃষ্ণের ভেতরের আসল সত্যকে জানার চেষ্টা করতে থাকেন। নিজের একাধিক চিঠিতে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রোকেও এই ব্যাপারে লিখেছিলেন তিনি। এতটাই ডুবে গিয়েছিলেন কৃষ্ণের চরিত্রে যে, পরে একটি সাংবাদিক সম্মেলনেও এর সম্পর্কে উল্লেখ করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিশ্ব জুড়ে নিউক্লিয় যুদ্ধের যে দামামা বেজে চলেছে, যে হারে মারণাস্ত্র তৈরি হচ্ছে, সেই ভয়ংকর জিনিসের সমাধান এই কৃষ্ণই করতে পারেন! তবে দিনের শেষে এই ‘কৃষ্ণ’ কি আমাদের পৌরাণিক কৃষ্ণ, নাকি অন্য কোনো ব্যক্তি, সেটা জানা যায়নি।
আরও পড়ুন
পিতৃতন্ত্রের গোড়ায় আঘাত পাঞ্জাবের ব্যবসায়ীর, জন্ম নিল 'গুপ্তা অ্যান্ড ডটার্স'
তবে এত মুগ্ধতার পাশে ভারতের কৃষকদের দুরবস্থা, গরিব মানুষগুলোর জীবন সংগ্রাম, অনাহার— এই দিকগুলো চে গ্যেভারার চোখ এড়িয়ে যায়নি। মহাজনি প্রথার বিরুদ্ধেও বলে গেছেন তিনি। তবে তিনি এটাও দেখেছিলেন, কী করে কৃষকরা তাঁর জমি, জায়গা, পরিবার, গরু-বাছুর আগলে রাখছে। নিজের জায়গাকে শক্ত করে ধরে রাখছে। চলে যাওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে কাশ্মীরের ভূমিকম্পও প্রত্যক্ষ করে যান তিনি। সেই সম্পর্কে রিপোর্টও দেন নেহরুকে। তারপর, বিমানে পাড়ি দিলেন অগ্নিযোদ্ধা। তাঁর সেই সাধের কলকাতায়, ভারতে আজও তিনি বিরাজমান। বিপ্লবের আগুন কি এত সহজে মুছে যায়!
আরও পড়ুন
বুকের কাছে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য একদিন’, পোস্টার হাতে ১০০ কিলোমিটার হাঁটছেন যুবক
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
চার টন জঞ্জালকে সারে পরিণত করলেন এই আবাসনের বাসিন্দারা