সত্তরের দশক। বাংলা ছায়াছবির স্বর্ণযুগ চলছে তখন। বিগ ফোর অর্থাৎ, সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক-তপন ছবি করছেন ফুটন্ত উদ্যমে। একের পর এক ছবিতে কয়েক পা এগিয়ে দিচ্ছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতিকে। সেসব ছবি প্রায়শই বিদেশে উচ্চ-প্রশংসিত হচ্ছে। তাঁদের যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছেন অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, নির্মল দে, দীনেন গুপ্ত, তরুণ মজুমদার, অগ্রদূত, অগ্রগামীর মতো মূলধারার পরিচালকরা। সঙ্গীতজগতের দিকপালরা স্বমহিমায় খ্যাতির মধ্যগগনে। সাহিত্য ক্ষেত্রেও নতুন এক ধরনের জোয়ার আসতে শুরু করেছে। আগের দশকেই ঘটে গেছে হাংরির পালাবদল। ক্রীড়া সংস্কৃতির পরিমণ্ডলেও কলকাতা তখন ভারতের পথপ্রদর্শক। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ভারতীয় নবজাগরণের ক্ষেত্রে যে শহর অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিল, রাজধানী স্থানান্তরের পর সেই শহরই পরিণত হল প্রান্তিক শহরে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের প্রবল ঝড়ঝাপ্টার পরও টানা কয়েক দশক কলকাতা তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখতে পেরেছিল। সত্তরের দশক বলতে গেলে সেই গৌরবোজ্জ্বল সময়ের অন্তিম পর্ব।
সত্তরের দশক ও বাঙালির সংস্কৃতি-চেতনার ইতিহাস নিয়ে হঠাৎ এতকিছু বলার কারণ হল ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ছবি, বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, ছবির একটি ছোট দৃশ্য। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালিত ‘ধন্যি মেয়ে’ মূলত হাসির ছবি হলেও শুরুর দিকে কলকাতার রাস্তায় আগত তিন গ্রামবাসীর ভাষা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ার দৃশ্যটি বর্তমান সময়ের একটি বিশেষ ক্রমবর্ধমান সমস্যার সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে যায়। পাঠক হয়ত এতক্ষণে বুঝে গেছেন, এখানে কোন দৃশ্যের কথা বলা হচ্ছে। কিছুদিন আগে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছিল দৃশ্যটির একটি স্থিরচিত্র। হিন্দি-আগ্রাসনের কাছে কীভাবে সে-আমলেও আত্মসমর্পণ করেছিল বাঙালিরা, সে-কথাই উঠে এসেছিল ভাইরাল ওই দৃশ্যে।
হাড়ভাঙা গ্রামের আসন্ন ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনাল ম্যাচের আগে গ্রামের ‘ধারাবিবরণী-বিশেষজ্ঞ’ ন্যাড়া (সুখেন দাস), তোতলা পুরোহিত রসময় ভট্টাচার্য (রবি ঘোষ) ও খেলোয়াড় ভোম্বল কলকাতায় আসে ফুটবল, ট্রফি, মন্ত্রের গ্রামোফোন রেকর্ড ও মাইক কিনতে। মাত্র দেড় মিনিটের এই দৃশ্যটিতেই দেখা গিয়েছিল, কলকাতায় এসে যাদের সঙ্গেই তাদের কথা বলতে হচ্ছে, তাদের কেউই বাংলায় কথা বলছে না। ফুটবলের দোকান, ট্রফির দোকান, গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান, পথচলতি মানুষ-সর্বত্রই কথোপকথন চলে হিন্দি অথবা ইংরাজিতে। সাদাসিধে ভটচায্যি পুরোহিতের পক্ষে এই বিজাতীয় ভাষায় বাক্যালাপ করা রীতিমতো যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়ায়। রেকর্ডের দোকানের মহিলা বিক্রেতা যা যা বুঝিয়ে চলেন, তা কিছুই না বুঝে অসহায়ের মতো তিনি ঘাড় নেড়ে যান। পথচলতি মানুষকে সময় জিজ্ঞাসা করলেও সেও হিন্দিতেই উত্তর দেয় – ‘ঘড়ি বনধ’। আর লোকটি চলে যাওয়ার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই অনবদ্য টাইমিংয়ে তিনজনের চোখে পড়ে খবরের কাগজের বোর্ডে আটকানো খবরের উপর। সেখানে কালো কালিতে বড় বড় করে বাংলাতেই লেখা ‘বাংলা বনধ’। সত্যকে চাপা দিতে কালো কালির নির্মমতাও বুঝি এখানে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন পরিচালক।
তবে সবচেয়ে প্রতীকী ফ্রেমটি তৈরি হয় কিছুক্ষণ পরেই, যখন দুটি মস্তান ছেলে দেওয়ালে বাংলাকে বাঁচানোর পোস্টার মারতে মারতে অত্যন্ত অশালীন সুরে বলিউডি গানের অবতারণা করতে থাকে। এবং সেখানেও তাদের দিকে যে বৃদ্ধা মারমুখী হয়ে তেড়ে আসেন, তিনিও হিন্দিতেই প্রশ্ন ছোঁড়েন। পোস্টারের বানানেও ‘বাঙ্গালী’, ‘বংলা’, ‘বাংলা’-সবকিছুরই অদ্ভুত জগাখিচুড়ি উপস্থিতি। বলাই বাহুল্য, যে বা যারা এই পোস্টার লিখছে এবং যারা মারছে, তারা আদৌ পোস্টারের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নয়। তাদের কাছে বরং অনেক বেশি আকর্ষণীয় ‘মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে’-র চটকদারি আবেদন। হিন্দির আধিপত্য তিনজনকে এতটাই বিভ্রান্ত করেছিল, যে মাইকের দোকানে গিয়ে তারা নিজেরাই প্রথমে হিন্দি ও ইংরাজিতে কথা বলতে শুরু করে। মাইক বিক্রেতা নন্দ-র ‘আ মোলো যা, বলি বাংলায় কথা বলতে কি জিভ খসে যায়?’-এর পর অবশেষে কলকাতায় প্রথম বাংলা-বলা লোক খুঁজে পায় তারা। তাও যেন ভটচায মশাইয়ের ধন্দ কাটে না। সরল মনে তিনি বলে বসেন – ‘এখানে তো কেউ বাংলায় কথা বলেই না।’
গল্পের কমিক গতির ভিড়ে হয়ত এই দৃশ্যটিও মানানসই হয়ে যায় মেজাজের জন্য। কিন্তু কলকাতা যে আস্তে আস্তে মিশ্র সংস্কৃতির জায়গা থেকে একটি অসুস্থ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে, তা যে তৎকালীন সুচিন্তক কলাকুশলীরা সহজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন, তা এই দৃশ্যে স্পষ্ট। শুধুমাত্র কমিক টাচ যুক্ত করতে এই দৃশ্যটি যে ব্যবহার করা হয়নি, তা অনুমেয়। বস্তুত, কলকাতায় প্রথম এসে গ্রামের মানুষদের ভাষা ছাড়াও অন্যান্য অনেক সমস্যায় পড়তে হয়, সেযুগে বরং তা আরও বেশি হত, তা নিয়ে হাস্যরসের দৃশ্য বাংলা সাহিত্য-সিনেমায় কম তৈরি হয়নি। এখানে তেমনই কোনও একটা দৃশ্য সহজেই তৈরি করতে পারতেন অরবিন্দ, কিন্তু তা না করে ক্রমশ বদলাতে থাকা শহরের চরিত্রকে তুলে ধরলেন অদ্ভুত স্যাটায়ারিক টোনে।
বাঙালির সংরক্ষণ প্রয়োজন কিনা সেই নিয়ে বিতর্কসভায় ঝড় তুলছেন পক্ষ-বিপক্ষ, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার খাপ পঞ্চায়েত, রবীশ কুমারের মতো কিছু সত্যিকার মানুষ এসে দোষত্রুটিকে ধরিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকের মতো। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়রা কিন্তু অনেকদিন আগেই ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।