অফিস থেকে বাড়ি ফিরবেন তিনি। ফিরতি বাসের অপেক্ষায় একলাই বসেছিলেন বাসস্টপে। খানিকক্ষণ পরে আরও একজন সহযাত্রী এসে হাজির হলেন সেই বাসস্টপে। আপন খেয়ালে ফোনে কথা বলে চলেছেন ওই ব্যক্তি। ঘড়ির কাঁটায় তখন বারোটা বেজে গেছে। এত রাতে সঙ্গী না থাকলেও, দ্বিতীয় কোনো সহযাত্রীর উপস্থিতি যেন বাড়তি সাহস জোগায়। তাই খানিকটা নিশ্চিন্তই হয়েছিলেন তিনি। তবে ফলাফল হল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ঘুম ভাঙতে তিনি আবিষ্কার করলেন, খোলা মাঠের মধ্যে শুয়ে রয়েছেন তিনি। মানি ব্যাগ, টাকা, হাতের আংটি কিছুই আর নেই তাঁর কাছে। তবে আরও বড়ো চমক ফোনের ইনবক্সে। আক্ষরিক অর্থেই নাকি তাঁর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নেমে এসেছে শূন্যে। রাতারাতি হাপিশ একজীবনের সমস্ত সঞ্চয়!
না, কোনো ক্রাইম থ্রিলারের গল্প নয়। এই ঘটনা বাস্তবের। লকডাউনে, হংকং-এর বিভিন্ন থানায় বার বার নথিভুক্ত হয়েছে এই ধরনের অভিযোগে। আশ্চর্যের বিশয় কোনো অভিযোগকারীরই স্মৃতিতে নেই, ঠিক কী হয়েছিল তাঁদের সঙ্গে। মিল বলতে একটাই। অপরিচিত কোনো ব্যক্তি এসে রুমাল ঝেড়েছিলেন তাঁদের মুখের কাছে কিংবা মুখের সামনে কাগজ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ঠিকানা। সেসময় মিষ্টি সুবাস নাকে এসেছিল। ব্যাস, ওইটুকুই। তারপর সবই ঝাপসা। তথ্যের অভাবে তদন্তের কাজও, সেইভাবে এগোতে পারছেন না হংকং-এর পুলিশ আধিকারিকরা।
ছুরি নেই, আগ্নেয়াস্ত্র নেই, তা সত্ত্বেও দিনে-দুপুরে এমন ডাকাতির পিছনে রহস্য কী? পুলিশ এবং গবেষকদের অনুমান, এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে ভয়ঙ্কর একটি ড্রাগ। হংকং-এর স্থানীয়দের কথায় যা পরিচিত ‘ডেভিল’স ব্রেথ’ বা ‘শয়তানের শ্বাস’ (Devil's Breath) নামে। ড্রাগটির রাসায়নিক নাম স্কোপোলামাইন (Scopolamine)।
আরও পড়ুন
সিন্থেটিক ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল নাৎসি সেনারা, ‘নেশা’র অভাবেই আত্মহত্যা হিটলারের?
না, এ জিনিস বাজারে নতুন নয়। স্কোপোলামাইনের আবিষ্কার হয়েছিল প্রায় দেড়শো বছর আগে। ১৮৮১ সালে। ল্যাটিন আমেরিকায় প্রাপ্ত একটি বিশেষ ফুলের নির্যাস থেকেই তৈরি করা হয়েছিল ড্রাগটি। তবে তখনও পর্যন্ত মাদক কিংবা হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি ‘ডেভিল’স ব্রেথ’। বরং, বিশ শতকের শুরুতে তা বহুলভাবে ব্যবহৃত হত চিকিৎসাক্ষেত্রে। চেতনানাশক ও যন্ত্রণানাশক হিসাবে মরফিনের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা হত এই জৈব ড্রাগ।
আরও পড়ুন
‘আইভারমেকটিন’ ম্যাজিক ড্রাগ নয়, ডেকে আনতে পারে বিপদও; জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা
ধীরে ধীরে কলোম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা এবং ইকুয়েডরে মাদক হিসাবে ব্যবহার শুরু হয় ডেভিল’স ব্রেথের। সেটা বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। আর তারপরেই সামনে আসে এই ড্রাগের আরও এক ভয়ঙ্কর ক্ষমতা। স্কোপোলামাইন খুব সহজেই হিপনোটাইজ করে দেয় মানুষকে। আর সেই চরিত্রটাকেই সামরিক কারণে কাজে লাগানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। বন্দি সেনাদের থেকে গোপন তথ্য আদায় করতে, তাঁদের ওপর স্কোপোলামাইন ব্যবহৃত হত মিত্র ও অক্ষ দুই জোটেই। মিলত আশানুরূপ ফলাফলও। হিপনোটাইজড অবস্থায় সেনাদের দেওয়া তথ্য প্রায় সঠিক হত ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই। তবে দুর্ঘটনাও ঘটত অনেক সময়। তীব্রতার কারণে, সামান্য বেশি পরিমাণে এই ড্রাগ মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে মৃত্যু পর্যন্ত হত। তাছাড়াও স্নায়ু, অন্ত্র এবং দৃষ্টিতেও নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় স্কোপোলামাইনের প্রভাবে। দেখা দিতে পারে মানসিক অসুখও।
আরও পড়ুন
মাত্র দুটি ড্রাগের মিলিত প্রয়োগেই সেরে উঠবে ফুসফুসের ক্যানসার, যুগান্তকারী আবিষ্কার
বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সামরিকক্ষেত্রে জৈবঅস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। সেইসময়ই ধামাচাপা পড়ে যায় ঘাতক ড্রাগটির কথা। কিন্তু আট দশক পরে আবার দুষ্কৃতিদের হাতিয়ার হয়ে ফিরবে এই ড্রাগ— তা কে-ই বা জানত? এর আগে আরও একটি ওষুধ ক্লোরোফর্মের ব্যবহারও অতিপরিচিত হয়ে উঠেছিল অপরাধ-জগতে। এবার তাকে যেন প্রতিস্থাপন করল শয়তানের শ্বাস। হংকং তো বটেই, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু অপরাধের সঙ্গেও ডেভিল’স ব্রেথ জড়িয়ে রয়েছে বলেই অনুমান তদন্তকারীদের। কিন্তু তা নির্দিষ্ট প্রমাণ দেওয়াই এখন সবথেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশাসনের কাছে…
Powered by Froala Editor