ক্রিকেট ভারতে ধর্মের মতো। টিম ইন্ডিয়ার একটি সিরিজ যখন চলে, তখন খুব কম সংখ্যক ভারতীয় আছেন, যাঁরা ম্যাচ সম্পর্কে খবরাখবর রাখেন না। কিন্তু ধরুন, কোনো ভারতীয় ক্রিকেট-প্রেমী এমন একটি দেশে বসতি স্থাপন করলেন, যেখানে ক্রিকেট নিয়ে কোনো আগ্রহ বা রুচি নেই। যেখানে ক্রিকেট ম্যাচগুলি কোনো টিভি চ্যানেলে দেখানো হয় না। কিংবা যেখানে এই খেলাটি নিয়ে কথা বলার মতো মানুষও নিমিত্তমাত্র। তখন কেমন হবে? কুলি লাইন্স, ওয়াহ ওস্তাদ, চামনলালের ডায়েরি-র মতো জনপ্রিয় বইয়ের লেখক এবং প্রবল ক্রিকেটপ্রেমী ড. প্রবীণ ঝা (Praveen Jha) এমনই এক দেশ, নরওয়েতে (Norway) বাস করেন। তাঁর নিবন্ধ থেকে জানা যায়, নরওয়ের ক্রিকেট ও ক্রিকেটপ্রেমীদের অবস্থা সম্পর্কে। সেখানে ভারতের ম্যাচগুলি কীভাবে উপভোগ করেন প্রবাসী ভারতীয়রা?
ড. প্রবীণ ঝা লিখছেন, দাবায় প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ যখন নরওয়ে এসেছিলেন, তখন ক্রিস্টিয়ানস্যান্ড শহরের মানুষ 'বিশি বিশি' বলে চিৎকার করে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তবে বিরাট কোহলি বা শচীন তেন্ডুলকরের মতো ক্রিকেট জায়ান্টরা যদি অসলো শহরে ঘোরাফেরা করেন, তখন তাঁদের নিয়ে ওই শহরে যে কোনো উত্তাপ চড়বে না, তা বলাই বাহুল্য। এমন কয়েক ডজন দেশ রয়েছে, যেখানে ক্রিকেট সম্পর্কে খুব কমই চর্চা হয়। উল্লেখ্য, ক্রিকেটের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মধ্যে ১৮৪৪ সালে হয়েছিল। কিন্তু সেই দেশগুলি এখনও টেস্ট বা বিশ্বকাপ খেলেনি। ইউরোপে ক্রিকেট নিয়ে নেদারল্যান্ডসের উত্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে এটাও বলতে হবে যে, তারাও ক্রিকেট সম্প্রদায়ের সমর্থন পায়নি। প্রবীণ ঝা যখন নরওয়ে পৌঁছন, খোঁজ করেন, কোনো ক্রিকেট ক্লাব আছে কিনা। দেখা গেল, নরওয়ের একটি জাতীয় দলও রয়েছে। যদিও সেই দলের কোনো খেলোয়াড় নরওয়ের বংশোদ্ভূত নয়। প্রায় সমস্ত খেলোয়াড়ই পাকিস্তানি। দলে একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত খেলোয়াড় হলেন প্রতীক অগ্নিহোত্রি। আশ্চর্যের বিষয়, পাকিস্তানি বোলার মহম্মদ আসিফও এখানকার একটি ক্লাবে খেলছিলেন। স্পট ফিক্সিং'-এর কারণে তাঁকে পাকিস্তান দল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাই তাঁর নরওয়ে এসে ক্রিকেটে সলতে পাকানো শুরু। ২০১৯ সালে আইসিসি একটি নতুন নিয়ম সামনে আনে। বলা হয়, আইসিসির কোনো সদস্য দেশ আন্তর্জাতিক টি-২০ খেলতে পারবে। নরওয়েও তাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়েছিল।
যে দেশ ছয় মাস ধরে বরফাবৃত বা অন্ধকারে ঢাকা থাকে, সেখানে কীভাবে ক্রিকেট সম্ভব? অসলো শহরে তবুও কিছু ক্রিকেট ক্লাব রয়েছে। কিন্তু শহর কোংসবার্গে তাও নেই। সেখানে ভারতীয়, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশি প্রবাসীরা একত্রিত হয়ে ক্রিকেট ক্লাব গঠন করেন। জলন্ধরের বিখ্যাত স্পোর্টস সংস্থা টাইকা থেকে ক্রিকেট কিট আনানো হয়। প্র্যাক্টিস এবং টুর্নামেন্ট আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া তারপর। ব্যস, শুরু হয়ে যায় ক্রিকেট। ক্রিকেট চলত যখন, এই শীতকালীন দেশের নাগরিকরা কৌতূহলের সঙ্গে দেখতেন যে, এটা কী খেলা হচ্ছে... বেসবলের মতন! ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁদের। একদিন কোনো পর্তুগিজ হাতে ব্যাট নিলেন। তবে ব্যাট হাতে ধরে তিনি বুঝতেও পারলেন না যে, তাঁর কী করা উচিত! এটা যদি ফুটবল হত, তবে তিনি অবশ্যই ড্রিবল করে দর্শকদের দিকে বলটি বাড়িয়ে দিতেন।
বিশ্বজুড়ে ফুটবল যতই বিস্তৃত হচ্ছে, ক্রিকেট সংকুচিত হচ্ছে ঠিক ততটাই। ফুটবলে ৩২টি দেশ বিশ্বকাপ খেলছে, সেখানে কেবল ১০টি মাত্র দেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপে। নিয়মিত খেলে আসা জিম্বাবোয়ে ও কেনিয়ার মতো দলগুলিও যোগ দিতে পারেনি সর্বশেষ বিশ্বকাপে। ক্রিকেট ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ মনে করেন, আইসিসি বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা কমিয়ে দিয়েছে। ক্রিকেট শুধুমাত্র একবার অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিল, তাও ১৯০০ সালে! 'বিগ-থ্রি' মডেল অনুসারে, ভারত, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া একে অপরের সঙ্গে খেলতে থাকে, বাকি দেশগুলির খেলা খুবই কম। তবে কালেভদ্রে বেশ কিছু দিক পরিবর্তন হয়েছে, যদিও পথ এখনও বাকি।
আরও পড়ুন
কৃষকদের গলফ : সুইজারল্যান্ডের এক আশ্চর্য খেলা
নরওয়েতে প্রবাসী ভারতীয়দের ক্রিকেট দেখার জন্য অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। ইউরোপে ক্রিকেট দেখার আইনি পদ্ধতিও সীমিত। সম্প্রচারের স্বত্ব এত ব্যয়বহুল যে, এখানকার চ্যানেলগুলি কেউ কেনেনই না। ২০২০-২১ মরশুমে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া 'লাইভ নাও' নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে চুক্তি করে। তবে তা কেবল অস্ট্রেলিয়ায় ম্যাচগুলির জন্যই। রয়েছে ইয়াপ টিভি নামে একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। যদিও এর বৈধতা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন। বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত হয় এমন আরও একটি পদ্ধতি ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক)। এগুলি ছাড়াও এমন অনেকগুলি অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট স্কোর দেখায়। তবে এখানকার প্রবাসীদের এই পুরো ব্যবস্থাটি আলাদাভাবে করতে হয়। ভারতে তো রাস্তায় রাস্তায় ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা চলে। শেষ ওভারের রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতে কোনো পথচলতি মানুষ অপরকে জিজ্ঞেস করেন, 'স্কোর কী?' কিন্তু নরওয়েতে এসব ভারতীয় প্রবাসীদের কাছে স্বপ্নের মতো।
আরও পড়ুন
দৃষ্টিহীনদের জন্য বিশেষ ফুটবল! অভিনব এই খেলার আঁতুড়ঘর উগান্ডা
Powered by Froala Editor