১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কালিম্পঙে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। প্রায়-অজ্ঞান অবস্থায় কেটেছিল সম্পূর্ণ দুটো দিন। তখন তাঁর বয়স ঊনআশি অতিক্রান্ত। দার্জিলিং থেকে সাহেব সিভিল সার্জন এসেছিলেন তাঁকে দেখতে। তাঁর বলিষ্ঠ শরীরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল-‘হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল বডি ডক্টর টেগোর হ্যাজ!’
ঊনআশি বছর বয়সে এসেও তাঁর এমন ‘ওয়ান্ডারফুল বডি’ সম্পর্কে জাত্যাভিমানী ব্রিটিশের গলায় উচ্চ প্রশংসা একথাই প্রমাণ করে, শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে কতখানি সচেতন ছিলেন মনেপ্রাণে রোমান্টিক কবি। আজীবন ভোরে উঠে নিয়মমতো সমস্ত কাজ সম্পন্ন করা তাঁর শেষ বয়স অবধি বজায় ছিল। কিন্তু কেবলমাত্র দৈনন্দিন কাজে নিয়মানুবর্তিতাই নয়, আলাদা ভাবে শরীরচর্চা ও খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বারবার বলতেন। আসলে তাঁর নিজের জীবনেও আশৈশব তিনি যে অভ্যাস করেছেন নিয়মিত শরীরচর্চার।
ছোটবেলায় অন্যান্য ভাইবোনেদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও জিমন্যাস্টিক্স, কুস্তি ও লাঠিখেলা শিখেছিলেন। তাঁদের জিমন্যাস্টিক্স শেখাতেন সে কালের বিখ্যাত ব্যায়ামবীর শ্যামাচরণ ঘোষ। কুস্তির শিক্ষক ছিলেন পালোয়ান হীরা সিং। ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে সাঁতারের ক্লাসেও ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে শিলাইদহে যখন যেতেন, পদ্মা বা গোরই নদীতে সাঁতার অভ্যাস করতেন। সুবিশাল পদ্মায় এপার-ওপার সাঁতার কাটা তাঁর কাছে কোনও বাধাই ছিল না। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, একবার তিনি ও তাঁর বাবা নৌকায় বসে আরাম করছেন। হঠাৎ অসাবধানতাবশত, রবীন্দ্রনাথের বড় সাধের কটকী চটিটি জলে পড়ে স্রোতের টানে বেশ অনেকটা দূরে চলে যায়। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে সাঁতার কেটে অনেক কসরতের পর সেটিকে উদ্ধার করেন। রথীন্দ্রনাথকেও জলে নামিয়ে সাঁতার কাটা শিখিয়েছিলেন। এছাড়া, ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি বিশেষভাবে তৈরি কাঠের মুগুর আনিয়েছিলেন। শিলাইদহের বাড়ির প্রাঙ্গণে ছিল টেনিস কোর্ট। স্বাস্থ্য ভাল রাখতে তিনি যে নিয়মিত টেনিস খেলতেন, এমনটাও শোনা গেছে। টেনিসে অনেকসময়ই তাঁর প্রতিপক্ষ হতেন ইংরেজরা। ১৮৮৯ সালে শোলাপুর থেকে বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে একটি চিঠিতে লিখছেন-‘সম্প্রতি একদা সন্ধ্যাবেলায় এখানকার ইংরেজ মন্ডলীর সঙ্গে (টেনিস) খেলবার সময় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে বসে আছি।’
শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গড়ে তুললেন যখন, তখন আশ্রমের ছাত্রদের শিক্ষার বিকাশের সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক বিকাশও যাতে হয়, সে বিষয়ে কড়া নজর রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিক্ষক হয়ে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ছিলেন কুস্তিগির। আরেকজন শিক্ষক রেবাচাঁদ ছিলেন দারুণ ক্রিকেট খেলোয়াড়। রবীন্দ্রনাথ নিজে কখনও ক্রিকেট খেলেছেন বলে জানা যায়নি, তবে ছাত্রদের ক্রিকেটে উৎসাহী করে তুলতে রেবাচাঁদকে নিয়োগ করেছিলেন। সারাদিন পড়াশোনার পর বিকালে খেলাধুলা করা ছিল আবশ্যিক। ১৯০৫ সালে জাপান থেকে সানোসান নামে একজন যুযুৎসুর শিক্ষক আসেন। অবশ্য তার আগে কুসুমোতো সান নামে আরেকজন জাপানি আশ্রমিকদের যুযুৎসু শেখাতেন বলে শোনা গেছে। পরবর্তীকালে যখন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, তখন ১৯২৯ সালে জাপানের নেকুজো তাকাগাকিকে নিয়ে আসেন যুযুৎসু শেখানোর জন্য। ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীদেরও এই আত্মরক্ষামূলক ক্রীড়াকৌশলটি শিখতে বলেন রবীন্দ্রনাথ। সময়ের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকা মানুষটিকে এই কাজের জন্য তীব্র নিন্দা করে রক্ষণশীল সমাজ। তাকাগাকি দু’বছর ছিলেন শান্তিনিকেতনে। পরে তাঁর ভরণপোষণের ভার বহন করা যাচ্ছিল না। ফলে কলকাতায় যুযুৎসু শেখাতে চলে যান তাকাগাকি। এমন মহৎ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ দুঃখ পেয়েছিলেন।
১৯৩০-৩১ সাল থেকে খেলাধুলাকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ডাইরেক্টর অফ স্পোর্টস নামের একটি পদ খোলা হয় বিশ্বভারতীর প্রশাসনে। আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক ব্রজরঞ্জন রায়, যাঁকে নিয়ে গৌরকিশোর ঘোষের ‘ব্রজদা’ চরিত্রটি, সেই ব্রজরঞ্জন রায় একবার রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন, খেলার নানা পরিভাষার বাংলা প্রতিশব্দের একটি অভিধান রচনার বিষয়ে মতামত নিতে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, এই কাজ বিশেষ জরুরি। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস অধিবেশনের আগে পড়াশোনার সিলেবাস তৈরির সময় রবীন্দ্রনাথের মত চাওয়া হলে তিনি বলেন, শিক্ষার মধ্যে ক্রীড়ার স্থান বড়। কিন্তু তাঁর দূরদর্শিতাকে কোনোরকম আমল দেননি রাজনৈতিক নেতারা। অবশ্য শান্তিনিকেতনে তার কোনও প্রভাব পড়েনি।
আশ্রমে নানারকমের খেলা হলেও ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটি ছিল বাঙালির এক ও অদ্বিতীয় ফুটবল। মোহনবাগানের হয়ে খেলা গৌরগোপাল ঘোষ এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে অঙ্কের শিক্ষক হয়ে। ‘পিতৃ-স্মৃতি’তে রথীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন তাঁদের ফুটবল-পাগলামির কথা। ফুটবল খেলতে খরচ কম বলে সকলেই উৎসাহী হয়ে মাঠে নেমে পড়তেন। তাঁদের দলও হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। আশ্রমের অনেক খেলোয়াড়-ছাত্রই পরবর্তীকালে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গন, রেলওয়েজের মতো দলে খেলেছেন।
সত্যিই তাঁদের দল অপ্রতিরোধ্য ছিল। আশেপাশের কোনও দলই আশ্রমের দলকে হারাতে পারত না। এই নিয়ে আবার এক মজার গল্প রয়েছে। একবার আশ্রমের ফুটবল দলের সঙ্গে খেলতে এসেছে কলকাতার ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের দল। আশ্রমের দল ডেভিড হেয়ারের দলকে আটটা গোল দিল। সবাই তো খুব খুশি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন - ‘এ হচ্ছে বাড়াবাড়ি। বাইরের ছেলেরা খেলতে এসেছে, হারাতে হয় এক গোল কি দু গোলে হারাও। তা নয়, পর-পর আট গোল। এ দস্তুরমত অসভ্যতা।’
Powered by Froala Editor