মধ্যরাতে পাশ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, দূরে নেই এনআরসি-ও – আপনি সুরক্ষিত তো?

গতকাল সারাদিন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা CAB নিয়ে সরগরম ছিল সংসদ। আর এর মধ্যেই, মধ্যরাতে ৩১১-৮০ ভোটে পাশ হয়ে গেল বিলটি। লোকসভায় শাসকগোষ্ঠী তথা বিজেপি সংখ্যাগুরু হওয়ায়, বিলটি পাশ করাতে যে বিশেষ অসুবিধে হবে না, তা অনুমান করা গিয়েছিল আগেই। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রথমে পাশ হয় বিলটি। আর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এও জানালেন, সারা দেশে এনআরসি-র চালু হতে দেরি নেই আর।

গতকাল সারাদিনই সংসদ সরগরম ছিল নানা বিষয় নিয়ে। তবে মূল যে কথাটি বারবার উঠে এসেছে, তা হল ধর্মীয় নিরপেক্ষতা। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল অনুযায়ী, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি ও খ্রিস্টান— এই ছয় ধর্মের ‘সংখ্যালঘু’ মানুষরা ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন না। বারবার কেবল একটি ধর্মের নামই উচ্চারণ করা হচ্ছে না। কাজেই, উক্ত ছয় ধর্মের কোনও শরণার্থীকে চিন্তায় থাকতে হবে না। তাহলে কি এবার ধর্মের ভিত্তিতেই আমাদের জাতীয় পরিচয় ঠিক করা হবে? সাম্যের অধিকারকে এভাবেই বিসর্জন দিতে হবে? সংসদ কক্ষে হোক, বা তার বাইরে এই প্রশ্নগুলোই করে গেছেন বিরোধীরা।

অমিত শাহের বক্তব্য, যেহেতু পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশগুলিতে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু, ফলে তাদের নিজেদের দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা নেই। বরং ওই দেশগুলির ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অনায়াসেই পাবেন ভারতের নাগরিকত্ব। শুধুমাত্র আবেদন করলেই হবে। লাগবে না রেশন কার্ড বা অন্য কোনো নথি। অমিত এও জানান, ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রসঙ্গত, অন্তত ৫ বছর বসবাস করলে তবেই দেওয়া হবে নাগরিকত্বের শিলমোহর।

তবে এর মধ্যেও দানা বেঁধেছে আরও একটা বিতর্ক। সংসদের ভেতরেই অমিত শাহ বলেন, এই দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রথম সামনে এনেছিল কংগ্রেসই। স্বাধীনতার সময়। জওহরলাল নেহরু এই ধর্মের ভিত্তিতেই দেশভাগ করেছিলেন। তাই এর প্রাথমিক দায় কংগ্রেসেরই। স্বভাবতই, এই মন্তব্যের পর প্রতিবাদ করে কংগ্রেস। সেই সঙ্গে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় প্রতিটি কথাতেই এখন কংগ্রেস এবং নেহরু চলে আসে। পান থেকে চুনটুকু খসলে তারও দায় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর। সত্যিই দায় কিনা, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু বারংবার এইভাবে ইতিহাসকে দোহাই দেওয়া কেন, এই প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। দেশভাগের সময় যা ঘটেছিল, যে বিপুল শরণার্থী, মৃত্যু দেখেছিল এই দেশ, তা তো ভোলার নয়। কিন্তু আজকের এনআরসি, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে যে চাপানউতোর, যে অভিযোগ— সেগুলোর ব্যাখ্যা কি ১৯৪৭ ও নেহরু হতে পারে? ইতিহাসবিদরা সেই প্রশ্নই তুলছেন। একই প্রশ্ন সাধারণ মানুষ ও রাজনীতিবিদদের একাংশেরও। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠছে, হিন্দুদের স্বস্তি দিয়ে যে বক্তব্যগুলো পেশ করা হচ্ছে, সেগুলোর কতটা প্রকৃত ভিত্তি আছে? কারণ, আসামে এনআরসি’র তালিকায় বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষের মধ্যে একটা বিশাল অংশ কিন্তু রয়েছে হিন্দুরাও।

অন্যদিকে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হয়ে যাওয়ায়, এনআরসি-র প্রয়োগে যে কার্যত আর কোনো বাধা রইল না, তাও স্পষ্ট হয়ে গেল। গতকালই জানা যায় উত্তরবঙ্গের এক লোকসঙ্গীতশিল্পীর কথা, যিনি নিজের বসবাসের নথি না পেয়ে আতঙ্কে আত্মহত্যা করেন। অথচ ওই শিল্পী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পী-তালিকার অন্তর্ভুক্তই ছিলেন। গত কয়েকমাসে এনআরসি-আতঙ্কে আত্মহত্যা করেছেন আরও অনেকেই। সেই তালিকায় হিন্দু-মুসলিম – বাদ নেই কেউই। বর্তমান পরিস্থিতি যে সেই আতঙ্ক আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই অভয় দিন, ভিটেছাড়া হবার আতঙ্ক সহজে যাবার নয়। কোন দিকে এগোচ্ছে বাংলা তথা ভারতের ভাগ্য?

More From Author See More