দিল্লির ঘটনা। খোদ রাজধানীতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে শায়িত হয়েই ঘুরেছেন করোনায় আক্রান্ত ৫১ বছরের ভদ্রমহিলা সীমা গন্ডোত্রা। অথচ ৬টি হাসপাতাল ঘোরার পরেও শয্যা মেলেনি কোথাও। টানা ১০ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর অ্যাম্বুলেন্সেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আবার লখনৌতে শয্যা পেলেও অক্সিজেনের অভাবে মারা যান ৩০ বছর বয়সী এক যুবক। দু-একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা না। সারা ভারতজুড়েই এখন এই একই দৃশ্য। মহামারীর এই দ্বিতীয় তরঙ্গের সামনে বাঁধ ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার।
বিগত এক সপ্তাহের রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যাবে ঠিক কোন দিকে এগিয়ে চলেছে দেশের পরিস্থিতি। ৭ দিনে ভারতে আক্রান্ত হয়েছে ১৫ লক্ষাধিক মানুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা ২০২০। পজিটিভিটি রেসিও ১৬ শতাংশেরও বেশি। যা মাত্র ৫ শতাংশের মধ্যে থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে পারতপক্ষে আক্রান্তের সংখ্যাটা আরও অনেকটাই বেশি। কারণ, পর্যাপ্ত পরিমাণ টেস্টও সম্ভব হচ্ছে না গোটা ভারতে। কেউ কেউ আবার আক্রান্ত হলেও ঘরোয়া পদ্ধতিতেই চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু মাস দুয়েক আগের অবস্থাও এতটা ভয়ঙ্কর ছিল না ভারতে। হঠাৎ করে কেন এত বাড়বাড়ন্ত? মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভ্রমণ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলির উদাহরণ সামনে থাকলেও, কোভিডের চরিত্র বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ভারত প্রশাসন। সেকেন্ড সার্জের সম্ভাবনাকে পুরোপুরিই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ভারতে।
দেখতে গেলে বাস্তবিক ক্ষেত্রেই তো তাই হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে যখন একটু একটু করে নিম্নমুখী হচ্ছিল সংক্রমণ, তখন থেকেই খুলে দেওয়া হয়েছিল সমস্ত কর্মক্ষেত্র, বিধি-নিষেধ। তা না করে উপায়ও ছিল না। তবে জনসচেতনতা, দূরত্ববিধি, মাস্কের বাধ্যতামূলক ব্যবহারের দিকে সেভাবে জোর দেয়নি প্রশাসন। দেশের মোট সংক্রমণ হাজার দশেকের মধ্যে চলে আসার পরই সরকারের ধারণা ছিল, যুদ্ধজয় সম্পূর্ণ হয়েছে। এমনকি গত মার্চের শুরুতেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ঘোষণা করেছিলেন, ভারত এখন করোনাযুদ্ধের ‘এন্ডগেম’-এ। আর তার ঠিক পরেই তাঁর ভুল ভেঙে দিল দ্বিতীয় তরঙ্গ।
আরও পড়ুন
৯৬ শতাংশ সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে পারে ‘ডবল মাস্ক’, পরামর্শ চিকিৎসকদের
তবে শুধু যে কোভিড আক্রান্তরাই চরমতম এই স্বাস্থ্যসংকটের মুখে তেমনটা নন। ভেঙে পড়েছে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থাটাই। কোভিডে আক্রান্ত না হলে ভর্তি করা যাবে না, কোথাও সরাসরি এমনটাই জানিয়ে দিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আবার কোনো দোকানে অক্সিজেন পাওয়া গেলেও নেই সিলিন্ডার। বলা হচ্ছে, বাড়ি থেকে সিলিন্ডার না আনলে অক্সিজেন পাবেন না গ্রাহকেরা। ফলত, পরিষেবা থেকে বঞ্চিত অ্যাজমা ও অন্যান্য কঠিন রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা।
আরও পড়ুন
করোনাকালে গৃহহীন ইংল্যান্ডের ৭ লক্ষ পরিবার!
ইতিমধ্যেই দিল্লি-সহ একাধিক শহরেই স্কুলগুলিকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করার পদক্ষেপ শুরু হয়েছে। অক্সিজেনের সরবরাহ সামাল দিতে শিল্প থেকে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের জন্য রূপান্তরিত করা হচ্ছে অক্সিজেনের উৎপাদনকে। কিন্তু এতকিছুর পরেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বলেই অনুমান আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের।
আরও পড়ুন
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় না মস্তিষ্ক, প্রমাণ দিলেন গবেষকরা
এখন একমাত্র উপায় টিকাকরণ। আর সেই লক্ষ্যেই মরিয়া হয়ে পথে নেমেছে ভারত। গত সপ্তাহেই জানানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ব্রিটেন এমনকি জাপানের নিয়ন্ত্রকদের দ্বারা স্বীকৃত যে কোনো ভ্যাকসিনই ব্যবহৃত হবে ভারতে। দ্রুততার সঙ্গে টিকাকরণ করা হবে ৯০ কোটি প্রাপ্তবয়স্কের। তবে দুটি প্রশ্ন উঠে আসছে এই সিদ্ধান্ত ঘিরে। প্রথমত বিশ্বের সর্বোচ্চ টিকা প্রস্তুতকারক দেশ হয়েও এমন সংকটে কেন ভারত? উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, কমে আসা সংক্রমণের কারণে দেশের নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত টিকার বন্দোবস্ত না করেই তা রপ্তানি করা হয়েছে অন্যান্য দেশে। আর সেই কারণেই হঠাৎ ঘাটতি ভ্যাকসিনের। দ্বিতীয়ত, ভারতের ভ্যাকসিন নির্মাতা সংস্থা ভারত বায়োটেক বছরে ৭০ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদনে সক্ষম। ফলত, ঘাটতিপূরণেও লেগে যাবে দীর্ঘ সময়। তার মধ্যে যে সংক্রমণ আকাশ ছোঁবে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো।
পরিস্থিতি ক্রমশ যেদিকে এগিয়ে চলেছে, তাতে হয়তো আগামীতে ট্রায়াজ পদ্ধতিকেই বেছে নিতে বাধ্য হবেন চিকিৎসকরা। তুলনামূলক কমবয়স্কদের এবং শারীরিকভাবে সক্ষমদের প্রদান করা হবে স্বাস্থ্য পরিষেবা। উপেক্ষিত হবেন বয়স্করা। সেই দিন আসতে খুব বেশি বাকি নেই। এমনকি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আতঙ্কিত চিকিৎসকরাও। প্রয়োজন না থাকলে যাতে বাড়ির বাইরে না বেরোন নাগরিকরা, সেই পরামর্শই দিচ্ছেন তাঁরা…
Powered by Froala Editor